গ্যাস-সংকটে ধুঁকছে ভালুকার অর্ধশত কারখানা

বর্তমানে এ এলাকায় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ থাকছে।

ময়মনসিংহের ভালুকার সিডস্টোর এলাকায় হালিম গ্রুপের এক্সিলেন্ট সিরামিক ও এক্সিলেন্ট টাইলস কারখানা। গ্যাস–সংকটের কারণে গত আগস্ট থেকে কারখানা দুটির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। গত মাসে গ্যাস–সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ১২ ঘণ্টা গ্যাসের চাপ শূন্য পিএসআই (গ্যাসের চাপ মাপার একক) থাকছে। এ কারণে এ সময় স্যানিটারিওয়্যার ও টাইলস উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

এক্সিলেন্ট টাইলসের কারখানায় দিনে ১ লাখ ১০ হাজার বর্গফুট টাইলস এবং এক্সিলেন্ট সিরামিকের কারখানায় ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ পিস স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। রাতে গ্যাস না থাকায় উভয় কারখানার উৎপাদন–সক্ষমতার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এতে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিন লোকসান হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। কারখানা দুটিতে এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

এ বিষয়ে এক্সিলেন্ট টাইলসের মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যান্ট) মো. শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনের বেলায় ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকলেও আমরা উৎপাদন করতে পারি সাত-আট ঘণ্টা। কারণ, সকালে গ্যাস আসার চুল্লির তাপমাত্রা ১২০০ ডিগ্রিতে তুলতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে। আবার সন্ধ্যায় গ্যাস চলে যাওয়ার আগেই ধীরে ধীরে চুল্লির তাপমাত্রা কমাতে হয়। তিনি আরও বলেন, গ্যাস–সংকটের কারণে ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন লোকসান দিয়ে খুব বেশি দিন টিকে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না।

গ্যাস–সংকটের কারণে ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন লোকসান দিয়ে খুব বেশি দিন টিকে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না।
মো. শামসুদ্দিন, মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যান্ট), এক্সিলেন্ট টাইলস

এক্সিলেন্ট সিরামিক ও এক্সিলেন্ট টাইলসের মতো ভালুকা ও ত্রিশালের অর্ধশতাধিক শিল্পকারখানা তীব্র গ্যাস–সংকটে ভুগছে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে। খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। ৪ জানুয়ারি সরেজমিনে ভালুকার কয়েকটি কারখানার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন কারখানার কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই গ্যাস–সংকট বাড়তে থাকে। তখন সন্ধ্যার পর গ্যাসের চাপ শূন্য পিএসআইয়ের কাছাকাছি চলে যেত। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে আবার কিছু গ্যাস পাওয়া যেত। তাতে আংশিক উৎপাদন করতে পারত কারখানাগুলো। তবে গত ৪ ডিসেম্বর থেকে সন্ধ্যার পর গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ থাকছে। লাইনে গ্যাস আসে সকাল ছয়টায়। দিনের বেলায়ও মাঝেমধ্যে গ্যাসের চাপ শূন্য পিএসআই হয়ে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ময়মনসিংহের এই অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ ধনুয়া ও ভালুকা স্টেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ডিসেম্বরের আগে উভয় স্টেশন থেকে গ্রাহকদের রেশনিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। শীতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ধনুয়া স্টেশন থেকে এখন আরও গ্যাসের রেশনিং করা হচ্ছে না। কিন্তু ভালুকা স্টেশন থেকে রেশনিং করে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এতে অর্ধশতাধিক শিল্পকারখানা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই এসব শিল্পকারখানার উদ্যোক্তা ও কর্মীরা সব গ্রাহকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

ত্রিশালের বগারবাজার এলাকায় সালমা গ্রুপের দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিল ও সুরাইয়া স্পিনিং মিল। একই শিল্পগোষ্ঠীর আরেকটি সুতার মিল বিএসবি স্পিনিং মিলস পাশের উপজেলা ভালুকায়। তিন কারখানায় কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী।

দবিরউদ্দিনে দিনে ৪৫ টন, সুরাইয়ায় ৪৮ টন ও বিএসবিতে ১৮ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বিএসবিতে গ্যাস–চালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাকি দুই কারখানায় গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের পাশাপাশি পল্লী বিদ্যুতের সংযোগও আছে। বর্তমানে রাতে গ্যাস না থাকায় বিএসবির উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। তবে বিকল্প বিদ্যুৎ–সংযোগ থাকায় দবিরউদ্দিন ও সুরাইয়ায় কিছু উৎপাদিত হচ্ছে। এতে তিন কারখানা দিনে পৌনে দুই কোটি থেকে দুই কোটি টাকা লোকসান গুনছে।

দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিলের উপমহাব্যবস্থাপক শংকর কুমার দাশ বলেন, রাতে গ্যাসের চাপ একেবারেই থাকে না। দিনেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস মিলছে না। তাতে বিএসবিতে সক্ষমতার ৩০-৩৫ শতাংশ এবং দবিরউদ্দিন ও সুরাইয়ায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। সুতায় মুনাফা এত কম যে এভাবে প্রতিদিন লোকসান দিয়ে উৎপাদনে টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।

দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিলের কারখানা চত্বরে শংকর কুমার দাশের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন বেলা সোয়া একটা। এ সময় তিনি গ্যাসের চাপ দেখিয়ে বলেন, বর্তমানে গ্যাসের চাপ মাত্র ৪ পিএসআই। এই চাপে সব জেনারেটর চালানো যায় না।

জানা যায়, গ্যাসের চাপ বেশি পেতে তিতাসের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করে ভালুকা স্টেশন থেকে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করে আকিজ সিরামিক, সালমা গ্রুপ ও মুলতাজিম স্পিনিং মিল। গত বছরের মার্চে এই পাইপলাইনে যুক্ত হয় আকিজ। পরে মুলতাজিমের একটি ইউনিটও যুক্ত হয়। ১৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপলাইনটিতে ১৫০ পিএসআই চাপে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ১৫-২০ পিএসআই।

ত্রিশালে আকিজ সিরামিকের কারখানায় বিভিন্ন ইউনিটে দিনে ৬০ হাজার বর্গমিটার টাইলস, ৫৫ হাজার পিস টেবিলওয়্যার এবং ৩০ থেকে ৩৫ হাজার পিস স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে গ্যাস–সংকটের কারণে বর্তমানে রাতে টাইলস কারখানা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে। সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস এনে স্যানিটারিওয়্যার ও টেবিলওয়্যারের ইউনিটের উৎপাদন অর্ধেক সচল রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ২৫-৩০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না।

আকিজের কারখানা চত্বর ঘুরে দেখা গেল, গুদাম উপচে ফুটপাতের ওপর কাঁচামাল চলে এসেছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মসিউর রহমান বলেন, প্রয়োজন অনুসারে বিদেশ থেকে নিয়মিত কাঁচামাল আমদানি করা হয়। কিন্তু গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তাই গুদামে আর কাঁচামাল রাখার জায়গা হচ্ছে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাতে গ্যাস না থাকায় আমরা খুবই কষ্টে আছি। প্রতিদিন মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে ভালুকায় কর্মরত তিতাস গ্যাসের উপব্যবস্থাপক মো. জুয়েল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। গত মাসে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব, তিতাসের এমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ এলাকা সফরে আসেন। তখন তাঁরা পিক আওয়ারে (চাহিদা যখন সর্বাধিক) লোডশেডিং এড়াতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেন। আমরা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখেছি, ভালুকার স্টেশন বন্ধ রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা যায়। যেটি ধনুয়া স্টেশন বন্ধ করলে হয় না।’

তাহলে কি কারখানাগুলো এভাবেই ভুগবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। অথবা আরপিসিএলে সরবরাহ কমাতে হবে। তাহলেই শিল্পে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।