৩০ বছরে প্রাইম ব্যাংক

শুধু মুনাফা করা প্রাইম ব্যাংকের উদ্দেশ্য নয়

বেসরকারি খাতের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি প্রাইম ব্যাংক। ১৯৯৫ সালে যাত্রা করা ব্যাংকটি আজ ২৯ বছর পূর্ণ করছে। এ উপলক্ষে প্রাইম ব্যাংকের নিজস্ব কার্যক্রমসহ ব্যাংক খাতের নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হাসান ও. রশীদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো:

২৯ বছর আগে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাইম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তার কতটা অর্জিত হয়েছে?

হাসান ও. রশীদ: ১৯৯৫ সালে কয়েকজন ব্যবসায়ী একত্র হয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁরা উৎপাদনশীল খাতের পাশাপাশি কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) খাতে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকটি গড়ে তোলেন। সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এখন আমাদের ঋণের ৭০ শতাংশ রয়েছে করপোরেট খাতে। এর মধ্যে সিংহভাগ উৎপাদনশীল খাতের ঋণ, ৬-৭ শতাংশ শুধু ট্রেডিং খাতে। দেশের প্রায় সব বড় করপোরেটকে আমরা অর্থায়ন করেছি। বাকি ঋণ গেছে এসএমই ও কৃষি খাতে। এভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গী হয়ে উঠেছে প্রাইম ব্যাংক। শুরু থেকেই এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দর্শন ছিল টেকসই ব্যাংকিং করা। এখন পর্যন্ত সে পথেই আছে প্রাইম ব্যাংক। টেকসই বলতে আমরা বোঝাচ্ছি, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে, পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে এবং দূষণ করছে না এমন প্রতিষ্ঠান, যাদের এ ব্যাংক অর্থায়ন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিবেশবান্ধব খাতে ৫ শতাংশ অর্থায়ন করতে বলেছে। অথচ এই খাতে আমাদের অর্থায়নের হার ১৯ শতাংশ। এভাবে টেকসই খাতে ২০ শতাংশের জায়গায় আমরা ৩৭ শতাংশ অর্থায়ন করেছি। আগে দেখা হতো শিশুশ্রম হচ্ছে কি না, এখন দেখা হয় কারখানাগুলো পরিবেশদূষণ করছে কি না। এ ছাড়া আমরা প্রযুক্তিতে ভালো বিনিয়োগ করেছি। এসবের ফল পাচ্ছি আমরা। আমাদের ব্যাংকের আয়ের তুলনায় খরচের অনুপাত এখন ৪২ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাংককে আরও দক্ষভাবে পরিচালনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ জন্য ডিজিটাল ও রোবোটিকসের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছি, যাতে খরচ আরও কমে।

দেশের প্রায় সব বড় করপোরেটকে আমরা অর্থায়ন করেছি। বাকি ঋণ গেছে এসএমই ও কৃষি খাতে। এভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গী হয়ে উঠেছে প্রাইম ব্যাংক।
হাসান ও. রশীদ, সিইও, প্রাইম ব্যাংক
প্রথম আলো:

প্রাইম ব্যাংক এসএমই ও করপোরেট গ্রাহকদের জন্য নতুন অনেক উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে এসেছে। এর সুফল কতটা মিলছে।

হাসান ও. রশীদ: পোশাক খাতের কর্মীদের জন্য মাঝেমধ্যে ছোট ঋণের প্রয়োজন হয়। আমরাই প্রথম ব্যাংক, যারা অ্যাপের মাধ্যমে পোশাককর্মীদের জন্য তাৎক্ষণিক ঋণের ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া আমাদের করপোরেট ও খুচরা গ্রাহকদের জন্যও রয়েছে পৃথক অ্যাপ। এসব অ্যাপে মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এখন আমরা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফএসি) পরামর্শে ডিজিটাল ব্যাংক সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। এর মাধ্যমে ব্যাংকের বর্তমান সেবাগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে দেওয়া হবে। ফলে অ্যাপের মাধ্যমে কয়েক মিনিটে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি আমরা মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালুর অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি। কৃষি এবং এসএমই খাতে আরও সহজে অর্থায়নের জন্য আমরা উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে আসছি। এর ফলে সারা দেশে আমাদের শাখা বা উপশাখা না থাকলেও গ্রাহক মিলবে।

প্রথম আলো:

একসময় প্রাইম ব্যাংক ক্যামেলস রেটিংয়ে শীর্ষে উঠেছিল, যা দেশের অন্য কোনো ব্যাংক এখন পর্যন্ত পায়নি। সেটা কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। কারণটা কী?

হাসান ও. রশীদ: রেটিং একটা নির্দিষ্ট সময়ের ওপর দেওয়া হয়। ব্যাংকের ভিত্তি কতটা মজবুত, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিচালনা পর্ষদ মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিআরএআর) সাড়ে ১৭ শতাংশ ধরে রাখতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে, যা থাকার কথা ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ। এ ছাড়া বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে, যা এখন সাড়ে ৩ শতাংশ। পাশাপাশি অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে যাচ্ছি। দেশের কোনো ব্যাংক যদি আবার ক্যামেলস রেটিংয়ে শীর্ষে ওঠে, তাহলে সেটা প্রাইম ব্যাংকই হবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। শুধু মুনাফা করা প্রাইম ব্যাংকের উদ্দেশ্য নয়। আমরা টেকসই অর্থায়নের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির টাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট করেছি। প্রতিবছর মেধাবীদের বৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া সাভার বা পূর্বাচলে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষের বিদেশনির্ভরতা কমে আসে।

প্রথম আলো:

প্রাইম ব্যাংক পুরোনো ব্যাংকগুলোর একটি, এরপরও সারা দেশে উপস্থিতি নেই। করপোরেটদের ওপর ভর করে বড় হয়েছে ব্যাংকটি। কেমন করছে দেশের করপোরেটরা।

হাসান ও. রশীদ: করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ ওঠানামা হয়েছে। গত এক বছরে অর্থায়ন–স্বল্পতা ও বিক্রি কমে যাওয়ায় গতি কিছুটা কমেছে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ কমেছে। আমি মনে করি, প্রতিটি খাতই একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত। করপোরেটদের নগদ প্রবাহ কমে যাওয়ায় কিছু ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর সবই খেলাপি হবে, তা বলা যাবে না। আমরা ঋণ তদারকি বেশ জোরদার করেছি। তবে এসএমই খাত সামনে চাপে পড়তে পারে।

প্রথম আলো:

আপনার চোখে মোটা দাগে দেশের ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?

হাসান ও. রশীদ: দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী নয়। সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সেবা মাশুল নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় চাহিদামতো মুনাফা করা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোর ভিত্তিও শক্তিশালী হচ্ছে না। এসবই বড় সমস্যা।

প্রথম আলো:

হঠাৎ ঋণের সুদহারে পরিবর্তন, ডলারের সংকট ও ব্যাংক একীভূত করার প্রভাব নিয়ে কিছু বলবেন কি?

হাসান ও. রশীদ: সুদের হারে পরিবর্তন হওয়ায় বড় গ্রাহকদের ওপর কিছুটা চাপ পড়েছে, বিশেষ করে যাদের ঋণ অনেক বেশি তারা। এ জন্য তারা বিকল্প অর্থায়নের দিকে যাচ্ছে। কেউ বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়ে ঋণ কমিয়ে আনছে। আমরা ডলারের জোগানের ওপর নির্ভর করে চাহিদা ঠিক করেছি। আমাদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের সীমা দিয়েছে। ফলে অন্যদের মতো ততটা সমস্যায় পড়িনি। ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগটি ইতিবাচক, এটা সময়ের দাবি ছিল। এখন একীভূত করার উদ্যোগ স্থগিত করে দেওয়ায় সবার জন্য ভালো হয়েছে। এই পাঁচটির অভিজ্ঞতায় পরেরগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ভালো হবে।