রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমল টানা দুই মাস

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় খাত এই দুটি। রিজার্ভ এখন ৩৫.৭ বিলিয়ন ডলার। দায় পরিশোধের পর ৩৪ বিলিয়নে নামতে পারে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুই উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় টানা দুই মাস কমেছে। এই কমতির ধারা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল বুধবার রপ্তানি আয়ের হিসাব প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও প্রবাসী আয় আসা কমেছে। গত মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই আয় গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম।

ইপিবির হিসাব বলছে, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কমার এই প্রবণতা শুরু হয় গত সেপ্টেম্বরে। এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল। অবশ্য সেপ্টেম্বরের সঙ্গে অক্টোবরের তুলনা করলে দেখা যায়, রপ্তানি আয় বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গতকাল ইপিবি রপ্তানির যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে সন্দেহের কথাও জানিয়েছেন রপ্তানিকারকেরা।

রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের দিকে এখন বাড়তি নজর রাখা হচ্ছে এ কারণে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। এতে ডলারের দাম বাড়তি, যা প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ। কয়েক মাস ধরে যে লোডশেডিং হচ্ছে, তারও পরোক্ষ কারণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া। ডলারের অভাবে বিভিন্ন ব্যাংক পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫৭২ কোটি) মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। পণ্য আমদানির বিপরীতে চলতি মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নামতে পারে। উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টেও রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বড় দুশ্চিন্তার কারণ। পোশাক খাতে ক্রয়াদেশও কমে গেছে।

ফলে এখন প্রবাসী আয়ে জোর দিতে হবে। আয়ের পাশাপাশি ডলার খরচ কতভাবে হচ্ছে, সেদিকে নজর বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানই বলেছেন, ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম দেখিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। তাহলে তাদের কী শাস্তি হয়েছে। দুবাইতে বাড়ি কেনায় কীভাবে বাংলাদেশিরা শীর্ষে উঠে এসেছে। এসব অর্থ কীভাবে বাইরে গেল?

মোস্তাফিজুর রহমান, প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ডলারের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এতে সামনে আয় কিছুটা বাড়বে।

পোশাকশিল্পের মালিকেরা ‘অবাক’

পণ্য রপ্তানিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুটা ভালো ছিল। প্রথম দুই মাসে ৮৫৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধিও ছিল ২৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি কমতে থাকে। অক্টোবরে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। অবশ্য অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে সার্বিকভাবে পণ্য রপ্তানি এখনো গত বছরের চেয়ে বেশি আছে। এই চার মাসে ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ।

পণ্য রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সাধারণত তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি বাড়লে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিও ইতিবাচক ধারায় থাকে। তবে অক্টোবরে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। মাসটিতে রপ্তানি হওয়া ৪৩৬ কোটি ডলারের পণ্যের মধ্যে পোশাক ৩৬৮ কোটি ডলারের। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। মানে হলো, পোশাকের রপ্তানি বাড়লেও অক্টোবরে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি কমেছে।

এদিকে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় অবাক হয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। তাঁরা বলছেন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন কী পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, তা পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। গত মাসের প্রথম ২০ দিনে পোশাক রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম ছিল। ২৮ অক্টোবরের হিসাবেও তা ১৫-১৬ শতাংশ কম ছিল। কিন্তু মাস শেষে ইপিবির হিসাবে দেখা গেল, আয় বেড়েছে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখে আশ্চর্য হয়েছি। তবে আমরা খুশি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ক্রয়াদেশের গতিও বাড়েনি। অনেক কারখানায় কাজই নেই।’

একই বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি। তারপরও রপ্তানি বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির আগে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না।’

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ১৭ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে।

প্রবাসী আয়েও ভাটা

ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই প্রবাসী আয় কমতে থাকে। গত অক্টোবরে প্রবাসীরা ১৫২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে কমেছিল ১০ শতাংশের বেশি।

অর্থবছরের প্রথম চার মাস মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৭২০ কোটি ডলারের মতো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের দাম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এতে প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

মালয়েশিয়া ও ইতালির এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য ১০৭ টাকার বেশি দামে ডলার কেনা যাচ্ছে না। তবে হুন্ডি বা অবৈধ পথে প্রতি ডলারে ১০৯ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বড় অঙ্কের আয় পাঠাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক্সচেঞ্জ হাউসে আসছেন না।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস তিনটি—রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, যা দেশের সক্ষমতা বাড়ায়।

জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘রাতারাতি আমরা বৈদেশিক মুদ্রার উৎস বাড়াতে পারব না। তাই প্রবাসী আয় বাড়াতে যা যা দরকার, তা করতে হবে। রপ্তানিকারকদের প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, অনুৎপাদন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ শক্তভাবে বন্ধ করতে হবে।