রাজস্ব আদায়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ হবে না

আসন্ন বাজেট সামনে রেখে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থাটি। রাজস্ব আদায় বাড়াতে সংস্থাটি কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হবে সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর শেষে এনবিআরের আদায় দাঁড়াবে ৩ লাখ সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

অর্থবছর শেষে এই বিশাল রাজস্ব ঘাটতির হিসাব দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। আগামী বাজেট সামনে রেখে বনানীতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ হিসাব তুলে ধরে পিআরআই। এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক। সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার জন্য রাজস্ব খাতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তা নিয়েও আলোচনা করা হয়।

পিআরআই বলেছে, আইএমএফের পূর্বাভাস ছিল, চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ টাকার রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু আইএমএফের সেই পূর্বাভাসের চেয়ে ২১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হবে এ বছর।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। পিআরআই বলেছে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি লাগবে ৩৬ শতাংশের বেশি। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি।

পিআরআই আরও বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে কর-জিডিপি অনুপাত দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত ৯২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। তারপরও সারা বিশ্বের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশে সর্বনিম্ন।

এদিকে বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে আইএমএফ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের স্বাভাবিক প্রবণতার বাইরে জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া করছাড়ও যৌক্তিক করতে হবে। আইএমএফ মনে করে, এই হারে কর আদায় বাড়লে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত হবে।

এ বিষয়ে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদ্যমান রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৫-২০ বছরে এনবিআরে অনেক সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। করছাড়ও কমাতে বলেছে আইএমএফ। আগামী বছর হয়তো কিছু ক্ষেত্রে করছাড় কমানো হবে। সংস্কারে হয়তো ‘মলম’ দেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু ‘সার্জারি’ করা যাবে না।

রাজস্ব বাড়াতে চার খাতে অগ্রাধিকার

পিআরআই রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি মোকাবিলায় চারটি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এতে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। পিআরআই বলছে, করজাল সম্প্রসারণ করে নিয়মকানুন পরিপালন করা হলে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা এবং করপোরেট কর থেকে প্রতিবছর ৯৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করা সম্ভব, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ১ শতাংশ।

এ ছাড়া ভ্যাট খাতে সংস্কার ও ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বছরে ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় সম্ভব হবে, যা জিডিপির দশমিক ৬ শতাংশের সমান।

আবার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর খাতের করছাড়ের সুবিধা উঠিয়ে দিয়ে বছরে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় সম্ভব, যা জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। এর বাইরে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম সংস্কার করলে সেখান থেকেও সরকারের বাড়তি আয় হবে।

পিআরআইয়ের পাঁচ পরামর্শ

রাজস্ব আদায় বাড়াতে পিআরআই পাঁচটি সুপারিশ করেছে। প্রথমত, করজাল সম্প্রসারণ করে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, বেশি সংখ্যক কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীকে (টিআইএন) রিটার্ন জমার আওতায় আনা। পিআরআই বলছে, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ পরিবার যদি ১০ শতাংশ হারে আয়কর দেয়, তাহলে কর-জিডিপি অনুপাত ১ দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়বে। তৃতীয়ত, করছাড় কমানো হলে জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়বে। চতুর্থত, ভ্যাট খাতে স্বল্পমেয়াদি সংস্কার করা। পঞ্চমত, সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার।

সংস্কারের জন্য কমিটি গঠনের পরামর্শ

এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব খাতে কার্যকর সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বছরের পর বছর সক্রিয় ছিল না। এই সংস্কার এনবিআর করবে না, রাজনীতিবিদদের করতে হবে। ভ্যাট আইন প্রচলনের সময় দেখেছি, প্রথম তিন বছরে ভ্যাট আইন তৈরি করা হলো। পরের ৫ বছর তা নিয়ে “কচলাকচলি” করা হলো। পরে যে আইন বাস্তবায়ন করা হলো, তা ১৯৯১ সালের আইনের চেয়েও খারাপ। দুর্ভাগ্যবশত এখনকার মতো অর্থনীতির খারাপ সময়ে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হচ্ছে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।’

প্রসঙ্গ রিজার্ভ  

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকট ১৫ মাস ধরে চলছে। এটি দীর্ঘায়িত হলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে। সার্বিক অর্থনীতির নানা দিক পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের দল গঠন করা দরকার। এখন পর্যন্ত সরকার যা করেছে, তা ক্ষুদ্র। তাতে রিজার্ভের কোনো লাভ হয়নি।

এই পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ হারিয়েছি। আগামী ৯ মাসে যদি আরও রিজার্ভ হারাই, তাহলে কী হবে?’ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ৫৪ শতাংশ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে, ৩৩ শতাংশ মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে। তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে কীভাবে? তাই ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে।

পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর বাড়িয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ করা যাবে না। আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করহার বরং কমাতে হবে। রাজস্ব বাড়াতে হবে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে।