দেশে জিডিপির অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিমাণ অনেক কম। এটিই দেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। তাই আয়বৈষম্য কমাতে ও কর–জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া কর অব্যাহতি সুবিধাও বাদ দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) ও ইকোনমিক রিপোটার্স ফোরামের (ইআরএফ) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বৈষম্য মোকাবিলা ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ কর প্রয়োগ’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। শনিবার রাজধানীর পল্টনে ইআরএফের কার্যালয়ে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ, এনবিআর সদস্য মাহমুদুর রহমান প্রমুখ।
র্যাপিড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশে কর–জিডিপির অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ। এটি সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। এর বড় কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ কর অনেক কম। দেশে যাঁরা গরিব মানুষ, তাঁরা আয়ের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দেন। আর বেশি আয়ের মানুষ সবচেয়ে কম ভ্যাট দিচ্ছেন। এতে বৈষম্য বাড়ছে।’
বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ ও প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ উল্লেখ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার আগামী দিনে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ ও পরোক্ষ কর কমিয়ে ৩০ শতাংশে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
করদাতার সংখ্যা বাড়াতে করমুক্ত ব্যক্তি আয়ের সীমা বাড়ানোর পরামর্শ দেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, করের আওতা বাড়ানোর এমন একটি পদ্ধতি আনতে হবে, যেটা দিয়ে আয় বাড়াবে। যেমন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সোশ্যাল ইনস্যুরেন্স নম্বর চালু করলে আয়-ব্যয়সহ করের হিসাব রাখা সহজ হবে। এতে কর আদায় বাড়বে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাঁদের অনেকে কর দেন না, আবার অনেকে কম কর দেন। এসব জায়গা থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য কমবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া কর অব্যাহতি সুবিধা কাজে আসছে না জানিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, অব্যাহতিগুলো তুলে দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো যায়। তা দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানো যাবে। একই সঙ্গে তিনি করনীতি ও কর প্রশাসন আলাদা করার সুপারিশ করেন।
সেমিনারে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ প্রত্যক্ষ করের হার বাড়িয়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত করার বিষয়কে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কারণ, এনবিআরের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে।
নাসির উদ্দিন আরও বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের সামনে এখন বড় বাধা রাজনৈতিক অর্থনীতি। কারণ, অনেক খাতেই কর অবকাশ সুবিধা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের অনেকেই ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে তাঁরাও কর ছাড়ের সুবিধা নিতে চান। এসব কারণে বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকা কর ছাড় দিতে হচ্ছে সরকারকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশ-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। আবাসন খাত, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ব্যবসার প্রসার হচ্ছে। এসব স্থান থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে কর পায় না। এ জন্য করনীতি সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।
অফিসকক্ষে বসে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি না করে জনগণের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, এতে জনগণ কর দিতে উৎসাহী হবেন।