আটার রুটি ও খাদ্যপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে
দাম কমায় দুই বছর পর গমের তৈরি রুটিসহ পুষ্টিকর খাদ্যে ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ। খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় টানা দুই অর্থবছর আটা ও আটা দিয়ে বানানো খাদ্যপণ্য তৈরির কাঁচামাল গমের আমদানি কমে যায়। ফলে মানুষের মধ্যে ভাত খাওয়ার ঝোঁক বৃদ্ধি পায়। এখন বিশ্ববাজারে গমের দাম কমতে থাকায় দেশে আটার দাম কমেছে। আবার চালের তুলনায় আটার দামও কম। সে জন্য ভাতের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর আটা ও আটা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ।
দেশে আটার ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা গম আমদানি বাড়িয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের সাড়ে ১১ মাসে (২০ জুন পর্যন্ত) গম আমদানি হয়েছে ৬৭ লাখ টন। এর আগের ২০২২–২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫১ লাখ টন। অর্থাৎ এক বছরে গম আমদানি প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। অর্থবছরের শেষ ১০ দিনে আমদানি আরও বাড়বে। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন ১৩ জাহাজ থেকে গম খালাস হচ্ছে।
সাধারণত চাল ও আটার মধ্যে যেটার দাম কমে, সেদিকেই ভোগের প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু বিশ্ববাজারে যেভাবে গমের দাম কমেছে, দেশে সেভাবে আটার দাম কমেনি। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ।
জানতে চাইলে বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, চালের দাম যদি আটার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে গরিব মানুষ আটার রুটি খাওয়া বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন পর চালের চেয়ে আটার দাম কম হওয়ায় গরিব মানুষের রুটি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ জন্যই গমের আমদানি বেড়েছে।
আবুল বশর চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে চালের তুলনায় গমের দাম অর্ধেকের কম। তাই চাল আমদানি কমিয়ে গম আমদানি বাড়ালে ডলার সাশ্রয় হবে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগে মোটা চালের চেয়ে আটার দাম ৮ শতাংশ বেশি ছিল। এখন কিন্তু চালের চেয়ে তা ২০ শতাংশ কম। বাজারে প্রতিকেজি খোলা আটা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দামি তথা মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা কেজি দরে।
দেশে চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ গম উৎপাদিত হয়। বাকি চাহিদা আমদানি করে মেটাতে হয়। গম আমদানি বাড়লে ভোক্তাদের জীবন ও অর্থনীতিতে নানা প্রভাব পড়ে। প্রথমত, ভাতের চেয়ে পুষ্টিকর হওয়ায় গম তথা আটা বাড়তি পুষ্টির জোগান দেয়। দ্বিতীয়ত, দেশে আটা দিয়ে নানা ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরির বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে। তাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। তৃতীয়ত, গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়বে। এসব কারণে গম আমদানি বাড়লে সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
খাদ্যাভ্যাসে আগের প্রবণতা ফিরে আসছে
খরচ বাঁচাতে একসময় গরিব মানুষ ভাতের বদলে আটার রুটি খেত। ভাতের চেয়ে পুষ্টিকর হওয়ায় এক দশক আগে উচ্চবিত্ত ও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের মধ্যেও আটার রুটি ও আটা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আবার ডায়াবেটিস রোগীরাও ভাতের বদলে একবেলা রুটি খেতে শুরু করেন।
খাদ্যাভ্যাসে এমন পরিবর্তনের ফলে গমের ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকে। যেমন রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগের বছর দেশে গমের ব্যবহারে রেকর্ড হয়। সেবার আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে গমের সরবরাহ দাঁড়িয়েছিল ৭৭ লাখ ৯০ হাজার টনে।
যুক্তরাষ্ট্রর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যাভ্যাস বদলে মানুষ চাল থেকে গমজাত খাদ্যপণ্যে ঝুঁকতে থাকায় এক দশকে গমের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়েছে। চালের তুলনায় দাম কম হওয়ায় এখন গমের ব্যবহার বাড়ছে।
এনবিআর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর বছর ২০২১–২২ অর্থবছরে দেশে গমের সরবরাহ কমে ৬ শতাংশ। পরের ২০২২–২৩ অর্থবছরে কমেছিল ১৪ শতাংশ।
দেশে রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার মতো কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের দেশগুলো থেকে গম আমদানি করা হয়।
শিল্পে কর্মব্যস্ততা ও রপ্তানি বৃদ্ধি
দেশে ভাত ছাড়া যত ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি হয়, তার বেশির ভাগই হয় আটা দিয়ে। গমের আমদানি বাড়লে খাদ্যপণ্য তৈরির কারখানা, বেকারি কনফেকশনারি ও হোটেল–রেঁস্তোরায় কর্মব্যব্যস্ততা বাড়ে। তাতে এই খাতে কর্মসংস্থান বাড়ে।
দেশ থেকে গম তথা আটা দিয়ে তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে গমের তৈরি শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছিল। কিন্তু এখন আবার রপ্তানি বাড়ছে। ইপিবির হিসাবে, চলতি অর্থবছরে ১১ মাসে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়েছে ২০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
ডলারের দাম বাড়ায় সুফল কম
কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রতি টন সাধারণ আমিষযুক্ত গম আমদানিতে খরচ পড়েছিল ৩৯০ ডলার। এখন পড়ছে ২৬০ থেকে ২৭০ ডলার। অর্থাৎ টনপ্রতি খরচ কমেছে ১২০ ডলার বা ৩১ শতাংশ।
তবে বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশে গমের দাম সেভাবে কমেনি। টিসিবির হিসাবে, দেশে এক বছরে খোলা আটার দাম কমেছে ২১ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত চাল ও আটার মধ্যে যেটার দাম কমে, সেদিকেই ভোগের প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু বিশ্ববাজারে যেভাবে গমের দাম কমেছে, দেশে সেভাবে আটার দাম কমেনি। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাও জরুরি।