বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলে খাদ্যের মূল্য নিয়ে যে কথা বলেছেন, তাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাঁর সতর্কবাণী, ইউক্রেন সংকটের জেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য আকাশ ছুঁতে পারে। অবস্থাপন্ন মানুষের জন্য তা বিশেষ উদ্বেগের না হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
সমস্যা হচ্ছে বিবদমান দুই দেশ, অর্থাৎ ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই মৌলিক খাদ্যসামগ্রী রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে। ইতিমধ্যে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে শুরু করেছে, বেড়েছে দাম।
ডেভিড বিসলে বলেছেন, এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে পড়েছে। বিষয়টি হলো দুই বছর ধরে সারা বিশ্ব করোনার সঙ্গে লড়াই করতে করতে যখন ক্লান্ত, যখন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, আর বুঝি খারাপ দিন আসবে না, তখনই এই যুদ্ধ। বাস্তবতা হলো পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন একসময় ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। বিশ্বের প্রায় এক–চতুর্থাংশ গম ও অর্ধেক সূর্যমুখীজাত পণ্য রপ্তানি করে এই দুই দেশ। আর ইউক্রেন প্রচুর ভুট্টা রপ্তানি করে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, যুদ্ধের ফলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী গমের দাম দ্বিগুণ হতে পারে।
ডেভিড বিসলে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বিজনেস ডেইলি প্রোগ্রামকে বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের আগেই বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি থেকে বেড়ে ২৭ কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হয়েছিল। এর জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেন তিনি—সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনাভাইরাস। তিনি বলেন, যেসব দেশ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে শস্যের বড় অংশ আমদানি করে, চলমান সংকটের প্রভাব তাদের ওপরই বেশি পড়বে। এ প্রসঙ্গে লেবাননের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তারা যত খাদ্যশস্য আমদানি করে, তার অর্ধেকই করে ইউক্রেন থেকে। এই তালিকায় আরও আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন, সিরিয়া ও তিউনিসিয়া—তালিকা আরও দীর্ঘ করা সম্ভব। বিষয়টি হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন ও সিরিয়া এখন খাদ্য আমদানি করতে না পারলে নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
নরওয়ের রাসায়নিক কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল বিবিসিকে বলেছে, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে ‘বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট’ দেখা দিতে পারে।
ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সালিস বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী ইভানা ডোরিচেঙ্কো বলেছেন, ইউক্রেনের অনেক কৃষক রুশ আক্রমণ ঠেকাতে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। সে জন্য তাঁরা ইতিমধ্যে ফসলের মাঠ ছেড়েছেন। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে, তা বলাই বাহুল্য।
ইভানা ডোরিচেঙ্কো বিবিসিকে বলেছেন, যাঁরা জমিতে কাজ করেন, তাঁরা সবাই এখন আমাদের জমি রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, জমি রক্ষা করা না গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কিছুই করার থাকবে না। এই মুহূর্তে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি মাতৃভূমি রক্ষার চেষ্টা করছেন না।
ডোরিচেঙ্কো আরও বলেন, এই যুদ্ধের কারণে কৃষিপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ধসে পড়েছে। রুশ আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী বন্দরে সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ করেছে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের আগেই খাদ্যের মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশ সংকটের মুখে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতিবিদ ওয়ানডিল সিহলোবো বলেছেন, তিনি আফ্রিকাসহ বেশ কিছু শস্য আমদানিকারক দেশের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে চিন্তিত।
দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষি ব্যবসাবিষয়ক চেম্বারের প্রধান অর্থনীতিবিদ সিহলোবো বিবিসিকে বলেছেন, যুদ্ধের কারণে যেমন সাময়িক মূল্যস্ফীতি হতে পারে, তেমনি যুদ্ধের পর প্রয়োজনীয় ফসলের ঘাটতি হতে পারে। বিশেষ করে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
সোমবার বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সার কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল সতর্ক করেছে, এই যুদ্ধের প্রভাবে সার উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। পরিণামে খাদ্যের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে, এমন আশঙ্কা আছে।
গ্যাসের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির আগে থেকেই বিশ্ববাজারে সারের দাম বাড়ছিল। বিষয়টি হলো রাশিয়ায় প্রচুর পরিমাণে সারের পুষ্টি উপাদান, যেমন পটাশ ও ফসফেট উৎপাদিত হয়। এখন রাশিয়া এসব উৎপাদন করতে না পারলে সারের সংকট হবে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জীবন বিঘ্নিত হবে।
পুনরুদ্ধার পিছিয়ে পড়েছে
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ বলছে, যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়বে। তবে উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরাই বেশি বিপাকে পড়বে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, উন্নয়নশীল দেশে শুধু জ্বালানি ও খাদ্যের চাহিদা বেশি, তা-ই নয়, এর পেছনে খরচও বেশি। যেমন পৃথিবীতে গড়ে চাহিদার ৩০ শতাংশ হলো জ্বালানি ও খাদ্য, সেখানে আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশ, যার অনেকটাই আমদানি করতে হয়। আবার উন্নত দেশগুলোতে মোট খরচের ১০ শতাংশ হয় এই দুইয়ের পেছনে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা ২৫ শতাংশ ও কম আয়ের দেশগুলোতে ৫০ শতাংশ।
মানুষের ব্যয় বাড়লে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তখন ব্যয় কমাতে তারা ভোগ কমায়, এটাই রীতি। আর তাতে পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়া আবার পিছিয়ে পড়বে।