ডলারের বিপরীতে দেশে দেশে মুদ্রার দরপতন

গোটা এশিয়ায়ই স্থানীয় মুদ্রা এখন দুর্বল। এ পরিস্থিতিতে ডলার বাদ দিয়ে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

দেশের অর্থনীতিতে এখন অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু টাকা নয়, ভারত, পাকিস্তানের রুপিসহ বিশ্বের অনেক বড় দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে গত এক বছরে কমেছে। অর্থাৎ হার্ড কারেন্সি হিসেবে ডলারের মান বেড়েছে।

দ্য ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, গত ২০ বছরের মধ্যে ডলারের মান এখন সবচেয়ে বেশি।

বিশ্লেষকদের মতে, এ মুহূর্তে ডলারের সাপেক্ষে অন্যান্য মুদ্রার দামের পতনের বহুবিধ কারণ থাকলেও প্রধান কারণ দুটি। এক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম থেকে রকমারি পণ্য—সবকিছুরই দাম বেড়েছে। অর্থাৎ ডলারের অঙ্কে সেই পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে। বহু ক্ষেত্রেই আমদানির পরিমাণ যেহেতু অন্তত স্বল্প মেয়াদে কমানো অসম্ভব, ফলে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেরই। তাতে ডলার মূল্যবান হয়েছে, উল্টো দিকে টাকার দাম পড়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। সারা পৃথিবীতে আর্থিক ক্ষেত্রে তুমুল অনিশ্চয়তা চলছে—এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলার সে দেশেই জমা রাখা লাভজনক, নিরাপদ। ফলে ভারতের মতো বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার ঢল পড়েছে। গোটা এশিয়াতেই স্থানীয় মুদ্রা এখন দুর্বল—চিনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন—সব কটিরই পতন ঘটছে। পাকিস্তান ও ভারতের মুদ্রারও পতন হয়েছে।

বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে স্থির হয়, সেই চাহিদা আর জোগানের অঙ্ক মেনেই বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে দেশীয় মুদ্রার দাম নির্ধারিত হয়। বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে। বিদেশ থেকে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে হলে বাংলাদেশের টাকা বা ভারতীয় রুপিতে সেই দাম মেটানো যায় না, তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। তাত্ত্বিকভাবে ডলার ও বাংলাদেশের টাকা এক হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিনিময় মাধ্যম হিসেবে টাকা ব্যবহৃত হয় না।

এক বছরে দেশে দেশে মুদ্রার পতন

ফিনপ্রেসো ডট কোর তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের মুদ্রার দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরপর ভারতীয় মুদ্রার দরপতন হয়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ, পাকিস্তানি রুপির ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ভিয়েতনামি মুদ্রা ডংয়ের শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ, ইউরোর ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ডের ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ, জাপানি ইয়েনের ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ, নেপালি রুপির ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, চীনা ইউয়ানের ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, মিসরীয় পাউন্ডের ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা রান্ডের ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ ও অস্ট্রেলীয় ডলারের ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

* বিশ্বের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এখনো মার্কিন ডলারে হয়ে থাকে। * বিশ্বে যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তার ৪০ শতাংশ মার্কিন ডলারে।

মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমার সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানেই এক দিকে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্য দিকে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়, তার কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলোরও দাম বাড়বে। অন্যদিকে এমন কিছু পণ্যও রয়েছে, যেখানে আমদানি খাতে বর্ধিত খরচ তৎক্ষণাৎ দাম বাড়িয়ে ক্রেতার ঘারে চালান করা যায় না। পণ্যমূল্য বাড়লে বিক্রি কমার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ে, কিন্তু এতে আবার বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার কমে যায়। তাতেও আবার পরিস্থিতি সামলানো যাবে কি না, সংশয় থেকে যায়। টাকার বিনিময় মূল্য আপাতত গভীর উদ্বেগের কারণ।

ডলারনির্ভর বিশ্ববাণিজ্য

দ্য ব্যালান্স ডট কমের তথ্যানুসারে, বিশ্বের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এখনো মার্কিন ডলারে হয়ে থাকে। বিশ্বে যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তার ৪০ শতাংশ মার্কিন ডলারে। সে জন্য বিশ্বের সব দেশের ব্যাংকের হাতে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে ডলার থাকতেই হয়। নন-আমেরিকান ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক দায়-দেনার দু–তৃতীয়াংশই মার্কিন ডলারে। সে কারণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভকে মুদ্রা বিনিময়ের পরিসর প্রতিনিয়তই বাড়াতে হয়। সব দেশের ব্যাংকের হাতে প্রয়োজনীয় ডলার মজুত রাখতে এর বিকল্প নেই।

ডলারে বিকল্প হয়ে উঠতে পারত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরো। কিন্তু ইউরো অঞ্চলের সংকটের জন্য সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দায়দেনা নিজেদের মুদ্রার চেয়ে ডলারেই বেশি সংরক্ষণ করছে। এ পরিস্থিতিতে ফেডারেল রিজার্ভসংকট এড়াতে ডলার বিনিময় হ্রাস করলে বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিলে ডলারের মূল্য বেড়ে যাবে।

চীন ও রাশিয়া ডলারের বিকল্প একক আন্তর্জাতিক মুদ্রার প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে। আপাতত তারা নিজেদের মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্য করছেও। ২০১৬ সাল থেকে চীনা মুদ্রা ইউয়ান রিজার্ভ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আইএমএফের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে মোট বৈশ্বিক রিজার্ভের মধ্যে ৭ দশমিক শূন্য ৮৭ ট্রিলিয়নই হচ্ছে ডলার, আর ইউয়ানের পরিমাণ মাত্র ৩৩৬ বিলিয়ন ডলার।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে বিষয়টি নির্ভর করবে বাণিজ্য অংশীদারের ওপর, অর্থাৎ তারা অন্য মুদ্রায় বাণিজ্য করতে চায় কি না। এ ছাড়া মুদ্রার প্রাপ্যতা এবং তার বিনিময় হারের ওপরও বিষয়টি নির্ভর করবে। একই সঙ্গে, এই সংকটকালে ওই মুদ্রার কতটা দরপতন বা দরবৃদ্ধি হলো, তা–ও দেখতে হবে।