শ্রীলঙ্কার সাবেক ডেপুটি গভর্নর উইরাকুন
শ্রীলঙ্কার মানুষ বিশ্বাস করে, দেশটির সব রাজনীতিবিদ কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত
শ্রীলঙ্কার সাবেক ডেপুটি গভর্নর উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা। ৪০ বছর তিনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিভিন্ন পদে চাকরির করে ২০১৯ সালে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে অবসর নেন। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ই-মেইলে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. শফিকুল ইসলাম।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কায় কেন এ পরিস্থিতি তৈরি হলো? এ পরিস্থিতি কি আগে থেকে সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: মাহিন্দা রাজাপক্ষের সময়েই এই সংকটের শুরু। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা করতে মাহিন্দা ২০০৫ সালে বেশ কিছু অর্থনৈতিক উন্নয়ননীতি হাতে নেন। সেসব নীতিতে রপ্তানি খাতকে অবমূল্যায়ন করে কেবল দেশীয় অর্থনীতির উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে দেশীয় বিনিয়োগ ও জিডিপি বাড়লেও সে তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি। ২০০৫ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে রপ্তানির অবদান ছিল ২৬ শতাংশ, ২০১০ সালে সেটি কমে ১৫ শতাংশ ও ২০২১ সালে ১২ শতাংশে নেমে আসে।
অন্যদিকে বেশ কিছু ‘অপ্রত্যাশিত’ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য শ্রীলঙ্কা সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে চীনসহ বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো শেষ পর্যন্ত লাভজনক না হওয়ায় তা দিয়ে ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ তৈরি করেনি। এর ফলে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। ২০১৯ সালে তা কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে।
এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বেশ কিছু ‘ভুল’ অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন। গোতাবায়ে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেন। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় ৪ শতাংশ কমে যায়। এ ছাড়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নিষিদ্ধের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে রাতারাতি অর্গানিক কৃষির দেশে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এটা ছিল আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে দেশে কৃষি উৎপাদন প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায়।
এসব ভুল নীতি বাড়িয়ে দেয় সরকারি ব্যয়। ক্রমবর্ধমান এই ব্যয় মেটাতে আরও বেশি ঋণ নিতে থাকে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃত্রিমভাবে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। এতে সংকট আরও প্রকট হয়। আমি মনে করি, শ্রীলঙ্কা যদি আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিত এবং মুদ্রার বিনিময় হারকে ধীরে ধীরে অবমূল্যায়নের সুযোগ দিত, তাহলে এই সংকট এড়ানো যেত। কিন্তু সেটি করেনি। তাই আমি মনে করি, এ সংকট মানবসৃষ্ট সংকট।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: চলমান সহিংসতা ও জনগণের আস্থাহীনতার পেছনে দুর্নীতির ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে শ্রীলঙ্কা বেশ খারাপ অবস্থানে রয়েছে। শ্রীলঙ্কার মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সব রাজনৈতিক নেতাই কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দেশের বাইরে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে, এমন কোনো শঙ্কা দেশটির রাজনীতিবিদ বা অর্থনীতিবিদদের ছিল কি? তাঁরা কি সরকারকে কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: দেশের অর্থনীতিবিদেরা ২০০৫ সাল থেকেই সব কটি সরকারকে অর্থনীতির সম্ভাব্য পতন সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা সেসব কথা খুব বেশি আমলে নেননি। নীতিনির্ধারকেরা শুধু কয়েকটি বিষয়ে সামান্য মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর না হওয়ায় অবস্থার আরও অবনতি হতে শুরু করে। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব। আর দেশটি অর্থনৈতিক পতনের অবস্থায় পৌঁছেছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ সংকটের পেছনে কতটা রাজনৈতিক, আর কতটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ছিল বলে আপনি মনে করেন? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কী যথাযথভাবে তাদের কাজ করতে করেছে?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: শ্রীলঙ্কার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আগে থেকে এমনিতেই খুব দুর্বল। এ দুর্বলতা কাটাতে ২০১৫ সালে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়। ওই সংশোধনীতে, সুশাসনের প্রয়োজন অনুসারে বেশ কয়েকটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্যোগ ২০২০ সালে করা সংবিধানের ২০তম সংশোধনীর মাধ্যমে উল্টে দেওয়া হয়। আর সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কা কি কোনো আন্তর্জাতিক ফাঁদে পড়েছিল?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: আমি মনে করি না। তবে অনেকে এমনটা বিশ্বাস করে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট এখন রাজনৈতিক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ঋণে জর্জরিত এই জাতির মুক্তির উপায় কী?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: সমাজের একটি বড় অংশ বিশেষ করে তরুণেরা সারা দেশে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তবে সবই ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। কিন্তু আন্দোলন ক্রমেই সহিংস হয়ে ওঠায় সরকার জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য করে। শ্রীলঙ্কা এখন একটি ফুটন্ত পাত্র। যেকোনো সময় তা আবারও বিস্ফোরিত হতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার তিনটি প্রধান আয়ের খাত—তৈরি পোশাক, চা এবং পর্যটন—সংকটে রয়েছে। সহিংসতার পর পর্যটকেরা দেশটিতে যেতে আরও বেশি নিরুৎসাহিত হতে পারে। এই খাতগুলোকে চাঙা করতে এ মুহূর্তে কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: শুধু পর্যটন বা পোশাক খাতই নয়, সমস্ত অর্থনৈতিক খাতই এখন সংকটে পড়েছে। জ্বালানি, রান্নার গ্যাস, ওষুধ ও খাবারের মতো দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি অব্যাহত রাখতে এখন বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। ভারতের দেওয়া দেড় বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঋণ ও চীনের ১০ বিলিয়ন ইউয়ান সোয়াপ ঋণ দিয়ে আপাতত পণ্য আমদানিপ্রবাহ ঠিক করা যেতে পারে। তবে এটি অপর্যাপ্ত। তাই এখন আইএমএফের কাছে সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা চলছে। তবে সেটিও বাস্তবায়িত হতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগবে। তাই এই সময়ের মধ্যে একটি বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অবস্থা কী হবে? এ ক্ষেত্রে কোনো আস্থার সংকট হবে কি?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গেই সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। চলমান সংকটে ভারত প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের সাধারণ ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। এটা খুবই কার্যকর সহায়তা ছিল। বাংলাদেশও আমদানির জন্য প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলারের সোয়াপ ঋণ দিয়েছে। যদিও এটি অপর্যাপ্ত, কিন্তু প্রয়োজনের সময় যে সমর্থন বাংলাদেশ দিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার সংকট নিয়ে চীন এখনো নীরব। ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কি কোনো পরিবর্তন হবে?
উইরাকুন এ উইজেবর্দেনা: চীন ইতিমধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই চীনকে সাইডলাইনে রাখাটা ভুল। এ ছাড়া যেহেতু শ্রীলঙ্কার প্রধানতম ঋণদাতা চীন (মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ), তাই চীনকে উপেক্ষা করার বাস্তবতা শ্রীলঙ্কার নেই।