চীনের ধনকুবেররা কেন একের পর এক নিখোঁজ হচ্ছেন

জ্যাক মা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চীনের ধনকুবেরদের হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলেন সে দেশের প্রযুক্তি খাতের চুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ধনকুবের বাও ফান। চায়না রেনেসাঁ হোল্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা এই ধনকুবেরের গ্রাহক তালিকায় আছে টেনসেন্ট, আলিবাবা ও বাইডুর মতো কোম্পানির নাম। অর্থাৎ নিছক সাধারণ গোছের ব্যবসায়ী নন তিনি।

তবে বাও ফানের অন্তর্ধানের সঙ্গে চীনের অন্যান্য ধনকুবেরের অন্তর্ধান ও ফিরে আসার কাহিনির মিল আছে। সেটা হলো তিনি হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই কোম্পানি থেকে ঘোষণা করা হলো, চীন সরকারের কোনো সংস্থার তদন্তে সহযোগিতা করছিলেন তিনি। কিন্তু সেই কোনো একটি সংস্থা যে কোনটি, তার নাম আজ পর্যন্ত কেউ মুখে আনেনি। বাও কোথায় আছেন, তা-ও এখনো জানা যায়নি। খবর বিসিসির।

এই অন্তর্ধান রহস্যের সবচেয়ে বড় নজির শিল্পপতি জ্যাক মা। ক্ষীণদেহী বেঁটেখাটো মানুষটি আলিবাবা গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান। ফোর্বসের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় বর্তমানে তাঁর অবস্থান ৬৪ নম্বরে।  

বিনিয়োগ, আর্থিক সাফল্য বা ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, ২০২০ সালের শেষের দিকে অন্য একটি কারণে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসেন জ্যাক। হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। সে বছর অক্টোবর মাসে সাংহাইয়ের একটি সমাবেশে শেষবার তাঁকে দেখা গিয়েছিল। সেদিন চীনের শাসক দলের সমালোচনা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। তার পর থেকে এখনো নিখোঁজ তিনি।

জ্যাক মায়ের অন্তর্ধানের খবর বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। জলজ্যান্ত মানুষটি কোথায় গেলেন, তাঁর কোনো হদিসই মিলছিল না। চীন সরকারও এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়নি। ফলে রহস্য ক্রমেই গাঢ় হয়।

জ্যাক মায়ের অন্তর্ধান চীনের অন্য কয়েকটি অনুরূপ অন্তর্ধানের দিকে আলোকপাত করে। বহির্বিশ্বের নজরে আসে, জ্যাক মা প্রথম নন, অতীতে তাঁর মতো হারিয়ে গেছেন আরও একাধিক ধনকুবের, সমাজের প্রভাবশালীরা।

অন্তর্হিত এই চীনা ধনপতিদের তালিকায় আছেন গুয়ো গুয়াংচ্যাং, ঝৌ চেংজিয়ান, রেন ঝিকিয়াং, শিয়াও জিয়ানহুয়া প্রমুখ। প্রত্যেকেই অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। এঁরা যেন সবাই খ্যাতির মধ্যগগনে উঠে হারিয়ে গেছেন।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে, প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অন্তর্হিত ধনকুবেররা কোনো না কোনোভাবে সরকার তথা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনায় সরব হয়েছেন। সরকার বিরোধিতার মাশুল তাঁদের দিতে হয়েছে, দাবি বিশেষজ্ঞদের।

চীনের বিনিয়োগকারী ধনকুবের গুয়ো গুয়াংচ্যাংয়ের অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ্যে আসে ২০১৫ সালে। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় লাখ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল গুয়োর। বিনিয়োগকারী হিসেবে এমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি যে অনেকে তাঁকে ‘চীনের ওয়ারেন বাফেট’ আখ্যা দিতেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি দীর্ঘদিন। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অবশ্য দাবি করেছেন, গুয়োকে চীনের পুলিশ সাংহাই বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, এমন ফুটেজ পাওয়া গেছে। গুয়ো দীর্ঘদিন লাপাত্তা থাকার পর ফিরে আসেন। আবার কাজেও যোগ দেন। কিন্তু তাঁর এই অন্তর্ধান নিয়ে কোথাও কেউ মুখ খোলেননি।

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সাংহাইয়ের জনপ্রিয় ফ্যাশন সংস্থার মালিক ঝৌ চেংজিয়ান হঠাৎ করেই লাপাত্তা হয়ে যান। তাঁকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, কোনোভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় ঝৌয়ের কোম্পানি।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়ায়, একটি দুর্নীতির ঘটনার তদন্তের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ঝৌকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু সবকিছুই এত গোপনে হয়েছে যে কেউ তাঁর খবর পায়নি। কয়েক সপ্তাহ পর ফিরে আসেন ঝৌ। কিন্তু যথারীতি এই আচমকা অন্তর্ধান সম্পর্কে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি।

২০২০ সালে একই কায়দায় আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান চীনের আবাসন খাতের ধনকুবের রেন ঝিকিয়াং। কোভিড যখন মহামারি আকারে চীন থেকে অন্যান্য দেশে ছাড়িয়ে পড়েছে, সেই সময় চীন সরকারের মহামারিসংক্রান্ত নীতির সমালোচনা করেছিলেন রেন। শুধু তা-ই নয়, চীনের প্রধানমন্ত্রী সি চিন পিংয়ের নাম না করলেও একাধিকবার তাঁকে উদ্দেশ করে ‘জোকার’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন রেন।

কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘদিনের সদস্য রেনকে স্বাভাবিকভাবেই এই ‘দুঃসাহসের’ মূল্য দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর সরকার জানায়, রেন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত। তাঁর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৮ বছরের কারাবাস হয় রেনের। ঘুষ নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো কিছু অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে অনেকেই বলেন, সরকারের সমালোচনা করার শাস্তিই ভোগ করছেন রেন।

চীনের আর এক বিনিয়োগকারী সংস্থা ‘টুমরো গ্রুপ’-এর প্রধান শিয়াও জিয়ানহুয়া সরকারের কোপানলে পড়েন ২০১৭ সালে। হংকংয়ের একটি হোটেল থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ, হুইলচেয়ারে বসিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে চীনের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা হয় শিয়াওকে। তার পর থেকে জনসমক্ষে তাঁকে আর দেখা যায়নি।

তবে চীন সরকার বারবারই বলে আসছে, এই শীর্ষ ধনীদের বিরুদ্ধে মূলত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার দুর্নীতির মূলোৎপাটনে বদ্ধপরিকর।  

চীনের সরকারব্যবস্থা

১৯৭৮ সালে অর্থনীতি উন্মুক্ত করে সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন। তখন থেকেই সে দেশে পশ্চিমা পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটে। ফুলেফেঁপে ওঠে অর্থনীতি। তৈরি হয় শক্তিশালী প্রযুক্তি খাত। এরপর ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ছাত্র বিক্ষোভের পর নীতি পরিবর্তন করে চীন সরকার। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে একধরনের স্বজনতোষী ব্যবস্থা, যেখানে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী—সবাই একাকার হয়ে যান। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বড় বড় কোম্পানি গড়ে ওঠে। অভিযোগ আছে, এরা আদতে সরকারের হয়েই কাজ করে।

কিন্তু এসব কোম্পানি এখন এত বড় হয়ে উঠেছে যে জ্যাক মার মতো ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো প্রকাশ্যে সরকারের বিরোধিতা করেন। চীন সরকার এখন তাই এদের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছে।