ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে জয় হচ্ছে বোয়িংয়ের

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান কোম্পানি বোয়িং। গত কয়েক বছরে দুর্ঘটনার কারণে বিক্রি কমলেও ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে বিক্রি বাড়ছে তাদের।ছবি: এএফপি

বাণিজ্যযুদ্ধে সাধারণত কেউ জেতে না। তবে মার্কিন বিমান কোম্পানি বোয়িং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে কিছুটা লাভবান হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব বাণিজ্য চুক্তিগুলো করছে, সেগুলোর অংশ হিসেবে বোয়িং ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন বিমান সরবরাহের কার্যাদেশ পাচ্ছে। এ ধরনের বিক্রি বোয়িংয়ের জন্য ইতিবাচক হতে পারে, কেননা, কোম্পানিটি কয়েক বছর ধরে নানা সংকটে আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করতে পারেন, তাঁর ব্যতিক্রমী বাণিজ্যনীতি মার্কিন উৎপাদন খাতের পালে হাওয়া দিচ্ছে।

এই মাসেই ইন্দোনেশিয়া ও জাপান বোয়িংয়ের শত শত যাত্রীবাহী বিমান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বছরের শুরুতে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার বোয়িংয়ের বিমান কেনার ঘোষণা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটল কাউন্সিলের বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষক ব্রুস হার্শ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদ থেকেই এ ধরনের চুক্তি করে আসছেন; তাঁর এসব চুক্তির আওতায় দেশগুলোর সঙ্গে বড় অঙ্কের পণ্য কেনাবেচার ব্যবস্থা হয়। আমাদের বাণিজ্য অংশীদারেরাও তা জানে। সে জন্য তারা বোয়িংয়ের মতো বড় জিনিস কেনার প্রস্তাব দেয়।’

বিমান বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব কার্যাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে খুব একটা চাপ দিতে হয়নি। এয়ারলাইনসগুলো বিমান কেনার মতো সিদ্ধান্ত সাধারণত মাসের পর মাস, এমনকি বছরের বেশি সময় ধরে নিয়ে থাকে। এ ছাড়া বিশ্বে বড় যাত্রীবাহী বিমান সরবরাহ করে কেবল দুটি কোম্পানি—বোয়িং ও ফ্রান্সের এয়ারবাস।

এরপরও বোয়িংয়ের নতুন এসব কার্যাদেশ পাওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের বাণিজ্য চুক্তির বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরছে। বোয়িং যুক্তরাষ্ট্রের লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস এবং অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক। এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বোয়িংয়ের শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব চুক্তির ঘোষণা আরও নতুন কার্যাদেশের পথ সুগম করতে পারে। অন্য গ্রাহকেরা হয়তো ভাববে, প্রয়োজনের সময় বিমান না পেলে বিপদ—তাই এখনই কার্যাদেশ দেওয়া নিরাপদ। এখন কার্যাদেশ দেওয়া হলেও বিমান হাতে পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

বোয়িং অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। ট্রাম্পের আগ্রহে যে তারা সন্তুষ্ট, সেটা বোঝা যায়। মে মাসে কাতারের সঙ্গে বোয়িংয়ের বিমান চুক্তির সময় কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কেলি ওর্টবার্গ ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান।

অ্যাভিয়েশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যাভিটাসের প্রেসিডেন্ট আডাম পিলারস্কি বলেন, ‘যদি প্রেসিডেন্ট নিজে বলেন আমার সঙ্গে চলুন— যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কর্মসংস্থান হবে, এমন চুক্তি করা হবে—এ কথা বললে তখন কেউ না বলতে পারেন না।’

তবে পিলারস্কি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এসব কার্যাদেশের আকার যতটা দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে বিষয়টি তার চেয়ে ছোট হতে পারে। এসব চুক্তি নিয়ে এখনো তেমন তথ্য প্রকাশিত হয়নি। অনেক চুক্তি হয়তো এখনো বিমান কোম্পানি ও এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে আলোচনার পর্যায়ে আছে।

জুলাই মাসেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইন্দোনেশিয়া ৫০টি বোয়িং বিমান কিনতে রাজি হয়েছে। তবে পরে এক ইন্দোনেশীয় কর্মকর্তা জানান, এটি এখনো গারুদা নামের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা ও বোয়িংয়ের মধ্যে আলোচনার পর্যায়ে আছে।

বিমান বিশ্লেষক রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেন, ‘আমরা একসময় ঠাট্টা করে বলতাম, এই ধরনের চুক্তি হলো এমওইউটিএইচএল, অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোজন করার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক। প্রেসিডেন্টের সফর শেষে প্রকৃত চুক্তি, অর্থায়নসহ বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চূড়ান্ত চুক্তি না হলেও এসব কার্যাদেশ অনেক সময় এমনিতেই হতো, ট্রাম্প থাকুন আর না থাকুন। যেমন মে মাসে কাতার এয়ারওয়েজ বোয়িংয়ের ১৫০টি বিমান কেনার কার্যাদেশ দেয়। এই চুক্তি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, করমর্দন—সবই ছিল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই কার্যাদেশ এমনিতেই হতো, হয়তো ট্রাম্পের সফরের কারণে সময় একটু এগিয়ে আনা হয়েছে।

তবে কিছু চুক্তিতে রাজনৈতিক চাপ ছিল বলেই মনে করেন কেউ কেউ। যা–ই হোক, বিমান হাতে পেতে যে সময় লাগে, তত দিনে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। বোয়িং ও এয়ারবাসের কাছে এমনিতেই হাজার হাজার কার্যাদেশ জমা আছে। অনেক এয়ারলাইন অর্ডার বাতিল করতে পারে, ডেলিভারি পিছিয়ে দিতে পারে, এমনকি বিমান কেনার পরিমাণও কমিয়ে ফেলতেও পারে। অনেক সময় নির্মাতা কোম্পানিগুলো এসব পরিবর্তন মেনে নেয়, যদি তারা অন্য কোনো ক্রেতার কাছে সেই বিমান বিক্রি করতে না পারে, তারপরও।

তবে বোয়িংয়ের মূল চ্যালেঞ্জ হলো, এই কার্যাদেশগুলো থেকে বাস্তব মুনাফা করা। কোম্পানিটির ৭৩৭ ম্যাক্সের ছোট ও বড় সংস্করণ এবং ৭৭৭-৯ মডেল সরকারি অনুমোদন এখনো পায়নি। এসব বিমান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) পরীক্ষা ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আছে। আরও একটি বিষয় হলো, নতুন বিমানের চাহিদা অনেক দিন ধরেই বেশি; কিন্তু সরবরাহ সীমিত।

বোয়িং এই ঘাটতি পূরণে কাজ করছে। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ৭৩৭ ম্যাক্স দুটি বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর এই মডেলের বিমান উৎপাদন প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। এরপর করোনা মহামারির কারণে সরবরাহব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসে। গত বছর একটি বিমানের অংশ মাঝ আকাশে খুলে যাওয়ার পর উৎপাদনের গতি আরও কমিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর কয়েক সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘটেও উৎপাদন পিছিয়ে যায়।

তবুও সমস্যা

ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বোয়িং আবার সমস্যায় পড়তে পারে। নতুন শুল্কের কারণে বোয়িংয়ের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। মার্কিন বাণিজ্য অংশীদারেরা পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বোয়িংয়ের বিক্রিতেও প্রভাব পড়তে পারে।

এই সপ্তাহে বাজেট এয়ারলাইনস রায়ানএয়ার বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি মার্কিন বিমান আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তারা বোয়িংয়ের সরবরাহ পিছিয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোয়িং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তিগুলো থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পেলে ইউরোপ পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে। তারা অন্যান্য দেশকে এয়ারবাস কেনায় উৎসাহ দিতে পারে।

বিশ্লেষক কোর্টনি মিলার বলেন, যদি এই খেলা চলতে থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, দীর্ঘ মেয়াদে কে বেশি কৌশলে খেলতে পারে। বিমান ব্যবসা, অর্থনীতি ও কূটনীতির পুরোনো যে টানাপোড়েন, তা আবার নতুন করে ফিরে এসেছে।