মার্কিন ঋণসীমা বাড়াতে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা, যেসব বিষয় মানতে হবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি
ছবি: এএফপি

শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টি। হাউস অব সিনেটের স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এ তথ্য দিয়েছেন।

এনবিসি নিউজ জানায়, গত শুক্রবারই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন বলেছিলেন, ঋণের সীমা বাড়ানো না হলে আগামী ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। তারপরই এই নীতিগত ঐকমত্য।

মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকার কী পরিমাণ ঋণ নিতে পারবে, তার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। গত কয়েক বছরে নাগরিকদের প্রণোদনা দেওয়াসহ নানা কারণে দেশটির জাতীয় ঋণ আইনি সীমা ৩১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলেছে। এ কারণে এখন তারা ঋণের সীমা বাড়াতে না পারলে আগামী ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

তবে ঋণের সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে ঐকমত্য এখন পর্যন্ত মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ঐকমত্যকে আইনি ভাষায় রূপান্তরিত করে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত সিনেটে পাস করিয়ে নিতে হবে। তবে ঋণের সীমা বৃদ্ধির জন্য ডেমোক্র্যাট সরকারকে কেন্দ্রীয় বাজেট কাটছাঁট করতে হবে।

গতকাল কেভিন ম্যাকার্থি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য যথাযথ এক ঐকমত্য আমাদের মধ্যে হয়েছে, নীতিগতভাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি, আজ রাতে (যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার দিবাগত রাত) এর লেখাপড়া করিয়ে নিতে হবে।’

ক্যাপিটল হিলে নিজ কার্যালয়ের সামনে কেভিন ম্যাকার্থি কথা বলার সময় আরও জানান, আজ রোববারের মধ্যে সমঝোতার খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং আগামী বুধবার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে এ নিয়ে ভোটাভুটি হবে। তিনি আরও বলেন, আজ এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা হবে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক পক্ষ এনবিসিনিউজকে বলেছে, ঐকমত্যের মধ্যে আছে দুই বছরের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যবহারের চুক্তি এবং দুই বছরের জন্য ঋণের সীমা বৃদ্ধির চুক্তির বিষয়। এ কারণে বিষয়টি কার্যত ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর ফয়সালা হবে। এ ছাড়া রিপাবলিকানদের দাবি মানতে হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের, যেমন পুষ্টি বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসূচি এসএনএপির সহায়তা পেতে হলে ৫৪ বছর বয়স পর্যন্ত বেকার থাকলে চলবে না। তবে গৃহহীন ও বর্ষীয়ানদের জন্য ছাড় আছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ফলে, এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের প্রথম খেলাপি হলে তাঁর নেতৃত্বের ওপর মানুষের আস্থা ধূলিসাৎ হতো। সেই সঙ্গে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, লাখ লাখ মানুষের কাজ চলে যেত।

জানা গেছে, গতকাল রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি দেড় ঘণ্টা কেবল নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন, এনবিসি নিউজ যাকে বিরল ঘটনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

কোন কোন বিষয়ে দুই পক্ষের ঐকমত্য

রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমা স্থগিত রাখা হবে। ফলে, বাইডেন সরকার নতুন ঋণ নিয়ে প্রতিশ্রুত সব অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। এর বিনিময়ে বাইডেন সরকার প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্যান্য খাতে স্বেচ্ছাধীন ব্যয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়াতে পারবে না, ২০২৫ সালে যা মাত্র ১ শতাংশ বাড়ানো যাবে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্যান্য খাতে ৯৩৬ বিলিয়ন ডলার স্বেচ্ছাধীন ব্যয় করবে বলে জানা গেছে।

প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি

জাতীয় ঋণসীমা বৃদ্ধির বিনিময়ে বাইডেন সরকারকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ১১ শতাংশ বাড়াতে হবে; যদিও ২০২৪ সালের বাজেটে তা বাইডেনের প্রস্তাবের মধ্যে ছিল। তাতে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৮৮৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।

কোভিডের তহবিল ফেরত আনা

কোভিড বাবদ যত বরাদ্দ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এর মধ্যে টিকাবিষয়ক গবেষণা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত তহবিলও ছিল। এই তহবিল ফেরত আনার বিষয়ে বাইডেন ও ম্যাকার্থির মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।

জ্বালানি খাতের অনুমোদন

দুই নেতার ঐকমত্যের আরেকটি দিক হলো, জ্বালানি এমনকি জীবাশ্ম জ্বালানিবিষয়ক প্রকল্পে দ্রুত অনুমোদন দেওয়া হবে। কেভিন ম্যাকার্থি ও রিপাবলিকান পার্টির কাছে এটি চুক্তির অন্যতম দিক। ডেমোক্র্যাটরাও গত মাসে এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান।

তবে মূল্যস্ফীতি সুরক্ষা আইনে পরিবেশগত যে দিক ছিল, বাইডেন তা নস্যাৎ হতে দেননি বলে রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে।  

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের ক্রমবিকাশ
ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট

খেলাপি হলে কী হতে পারে

বৈশ্বিক আর্থিক খাতের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড। দেশটি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঠিক কী হবে, তা বলা কঠিন; যদিও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা আশঙ্কা করছেন, সে রকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের ইকুইটি, ঋণ ও অন্যান্য বাজারে ব্যাপক টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

ওয়াল স্ট্রিটের নির্বাহীরা সতর্ক করেছেন, ট্রেজারি বাজার ঠিকঠাক কাজ না করলে তার প্রভাব দ্রুত ডেরিভেটিভ, মর্টগেজ ও পণ্যবাজারে ছড়িয়ে পড়বে। এর কারণ, বাণিজ্য ও ঋণ সুরক্ষিত রাখতে যেসব ট্রেজারি জামানত হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিনিয়োগকারীরা সেগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। যেসব বন্ডের ঋণের কিস্তি বকেয়া পড়েছে, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেগুলোর বদলে অন্য জামানত দিতে বলা হতে পারে।

এমনকি স্বল্প সময়ের জন্যও যদি ঋণের সীমা লঙ্ঘিত হয়, বাজারে তার বড় প্রভাব পড়তে পারে। যেমন এতে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি ইকুইটির মূল্য কমতে পারে, ঋণচুক্তির শর্ত লঙ্ঘন ও স্বল্পমেয়াদি তহবিল বাজারে স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি, আর্থিক বাজার ও বিভিন্ন আর্থিক কার্যক্রমে এর নেতিবাচকভাবে প্রভাব পড়তে পারে।

মুডিস অ্যানালিটিকস বলেছে, ঋণের সীমা লঙ্ঘিত হলে স্বল্পমেয়াদি তহবিল বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।