বুদ্ধিবৃত্তিতে মহিরুহ ছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সলো: দ্য ইকোনমিস্ট

রবার্ট সলো
নোবেলপ্রাইজ ডট অর্গ

১৯৮৭ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া রবার্ট সলো বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে ছিলেন মহিরুহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সৈনিক হিসেবেও কাজ করেছেন। গত ২১ ডিসেম্বর তিনি মারা গেছেন।

দ্য ইকোনমিস্টের এক সংবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর বীরত্বের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা এ রকম: নাৎসি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে শিবিরের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন সলো। পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক লরির ভেতরে লুকিয়ে তিনি ইতালিতে নাৎসি বাহিনীর বেতার সংকেত ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এ কাজটা আমরা খুব ভালোভাবে করতে পারতাম।’ তাঁর কৌশল ছিল শত্রুপক্ষের কাছাকাছি গিয়ে গুপ্ত সংকেত ধরে ফেলা, কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার মতো কাছাকাছি না যাওয়া।

বাস্তবতা হলো, নাৎসি বাহিনীর সেই সংকেত অলীক বস্তু ছিল না, সেখানে ছিল যুদ্ধের তথ্য। সেই সংকেত ভাঙা গেলে হয়তো অস্ত্র সরবরাহের খবর পেয়ে চালান রুখে দেওয়া যাবে। পরবর্তী জীবনে রবার্ট সলোর মধ্যে যে সমতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা তার পালে হাওয়া দিয়েছিল।

কারও ওপর যেন বসগিরি করতে না হয়, সে জন্য রবার্ট সলো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হতে চাননি। ১৯৪৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দিলে তিনি জানতে চান, অধ্যাপকদের সর্বনিম্ন বেতন কত এবং সেই বেতনে তিনি চাকরি নেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজর্সে কাজ করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সুইস দূতাবাস তাঁর পদক্রম সম্পর্কে জানতে চায়। জবাবে সলো বলেন, তিনি এমআইটির পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক এবং সরকারের পদক্রমে এর চেয়ে বড় পদ নেই। এরপর ১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসের এক ভোরবেলা নোবেল পুরস্কার লাভের খবর পেয়ে প্রথমেই তাঁর যা করতে ইচ্ছা হয়েছিল সেটা হলো, আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া।

পুরস্কারের চেয়ে যে বিষয়টি রবার্ট সলোর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হলো গোষ্ঠীর সাহচর্য—ছোট কিন্তু অত্যন্ত অনুপ্রাণিত সহকর্মীদের সাহচর্য যে প্রেরণা জোগায়, সেটা। তিনি বলেছেন, ‘ভালো কাজ করছে এমন গোষ্ঠীর সদস্য হলে আপনার মনোবল বাড়বে।’ অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি আনুষ্ঠানিক মডেল ও গণিত পছন্দ করতেন। তবে অতিরিক্ত শুদ্ধতার পক্ষপাতী ছিলেন না। বলতেন, এ ধরনের মানুষেরা ব্যানানা বা কলা শব্দটির বানান হয়তো জানে, কিন্তু কোথায় থামতে হবে, তা জানে না। তাঁর কৌশল ছিল প্রবৃদ্ধি, সম্পদ ও বেকারত্বের মতো বড় বড় বিষয় ভেঙে ছোট করে ফেলা। তাঁর আশা ছিল, ছোট ছোট উত্তর একত্র হয়ে বড় কিছু হয়ে উঠবে।

এমআইটির যে সংস্কৃতি সলো আত্মস্থ করেছিলেন তা ছিল কর্তৃত্ববিরোধী, সেখানে ছিল একত্রে কাজ করার মানসিকতা, বন্ধুত্ব ও ছাত্রদের সময় দেওয়া। অনেক ছাত্র তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠেন। পরিণতি হলো, পরবর্তীকালে রবার্ট সলোর চারজন ছাত্র তাঁর মতোই ভোরবেলা সুইডেন থেকে ঘুমভাঙানিয়া ফোনকল পেয়েছিলেন, অর্থাৎ তাঁরাও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সলো বিশ্বাস করতেন, অর্থনীতি একধরনের ‘কুটির শিল্প’—কখনো কখনো যা অধ্যাপক ও ছাত্র সহকারীর শক্তিশালী গবেষণা হাতিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়।

বিদ্যায়তন সম্পর্কে যে বিষয়টি তাঁর ভালো লাগত সেটা হলো, এই পরিমণ্ডলে যেকোনো চিন্তা নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়, তা সে চিন্তা যত মর্যাদাপূর্ণই হোক না কেন। তাঁর সমালোচনা ছিল ক্ষিপ্র ও রসিকতাপূর্ণ, সে জন্য কখনো কখনো অন্যদের পক্ষে তা গ্রহণ করা কঠিন হতো। গত শতকের সত্তরের দশকে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রথাগত গবেষণার ধারাকে চ্যালেঞ্জ জানানো ফ্রেশওয়াটার স্কুল অব ম্যাক্রোইকোনমিকসকে তিনি উদ্ভট মনে করতেন। বিশেষ করে এই ঘরানা যে মনে করত প্রতিনিধিত্বমূলক অনুঘটক পুরো অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রতিনিধিত্বমূলক হতে পারে, তিনি এ ধারণার সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন, এ ঘরানার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করার মানে হলো, অশ্বারোহী সেনাদলের কৌশল নিয়ে এমন মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা, যাঁরা নিজেদের নেপোলিয়ন মনে করেন।

কেন নোবেল পুরস্কার

রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস ১৯৮৭ সালে সলোকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি গাণিতিক মডেল তৈরি করেন, যা আজও অর্থনীতির অন্যতম সম্পদ। পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তাঁর সৃষ্ট গাণিতিক মডেলে বোঝা যায়, বিভিন্ন উপাদান কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে আসে। তাঁর কাজের আলোকে গত শতকের ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়।

১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালে তাঁর বেশ কিছু নিবন্ধ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সলো দেখান, তত দিনে অর্থনীতিবিদদের প্রস্তাবিত বৃদ্ধির মডেলগুলো অপর্যাপ্ত; কারণ সেই মডেলগুলোতে পুঁজি ও শ্রমে নজর দেওয়া হয়েছিল। নোবেল জয়ের পর তিনি শিকাগো ট্রিবিউনকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। তাঁর কাজ থেকে যে বিষয়টা উঠে এসেছে তা হলো প্রযুক্তির পরিবর্তন—বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও তার অগ্রগতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

অর্থনীতিতে প্রযুক্তির প্রভাব পরিমাপের পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের কাছে অধরা ছিল। সলো বলেছিলেন, এ নিয়ে শুরু থেকেই তাঁর ভাবনা ছিল। তাঁর ভাষ্যে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের বড় সুযোগ আছে, যা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মিনিয়াপোলিসের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে ২০০২ সালে এমনটাই বলেন তিনি। আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও তাঁর বন্ধু পল স্যামুয়েলসন এমআইটিতে তাঁর গবেষণা সহকারী ছিলেন। ১৯৭০ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান তিনি। সলো করনীতি ও ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের সক্রিয় ভূমিকার পক্ষে কথা বলেছিলেন, যে ধারণার জন্মদাতা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস।

মডেলপ্রণেতাদের প্রতি পরামর্শ

সলোকে প্রবৃদ্ধির মডেলের জনক বলা হয়। তাঁর কাজের পর এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু তিনি তাঁদের অনেক কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিশেষ করে পরিসংখ্যানগত চর্চা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন তিনি, যে চর্চার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা দেশের প্রবৃদ্ধির হার কাটাছেঁড়া করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। তাঁর পরামর্শ হলো, যাঁরা অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করেন, তাঁদের কেস স্টাডি ও ব্যবসায়িক ইতিহাস থেকে শেখা উচিত। লক্ষ্য হচ্ছে, বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের সাগরে ডুবে না গিয়ে একধরনের ব্যবহারযোগ্য হাইপোথিসিস তৈরি করা। অর্থাৎ অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে অর্থনীতির কাছাকাছি যেতে হবে, কিন্তু বেশি কাছে যাওয়া যাবে না।