আর্জেন্টিনায় ‘শক থেরাপি’, ১০ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ঘোষণা

আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়া শহরছবি: সংগৃহীত

অতি উদারবাদী হাভিয়ের মিলেই আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দুই দিন পরই তাঁর অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী লুই কাপুতো সরকারের ১০টি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ডানপন্থী হাভিয়ের মিলেই সংকটে জর্জরিত দেশটির রাজনীতিতে তিনি অনেকটাই বাইরের মানুষ। তবে তিনি অর্থনীতির খোলনলচে বদলাতে চেয়েছেন, অর্থনীতিতে ‘শক থেরাপি’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটির অর্থনীতি জটিল এক সমস্যায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ৩ অঙ্কের ঘরে, অর্থাৎ ১০০ শতাংশের বেশি। অর্থনৈতিক মন্দা ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। পাশাপাশি বাড়ছে দারিদ্র্য। রাজনীতির মূলধারার প্রতি সাধারণ মানুষের যে তীব্র ক্রোধ দেখা গেছে, সেই স্রোতে চড়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়েছেন ৫৩ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ মিলেই।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার ঘোষণা করা পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে মুদ্রার বিনিময় হারের সিদ্ধান্ত। একলহমায় স্থানীয় মুদ্রা পেসোর দাম মার্কিন ডলারের বিপরীতে অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পেসোর অবমূল্যায়ন হয়েছে ৫০ শতাংশ। আগে ১ ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ছিল ৪০০ পেসো, এখন এর দাম ৮০০ পেসো।

আরেক আলোচিত সিদ্ধান্ত হলো, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ১৮ থেকে ৯–এ নামিয়ে আনা। বিভিন্ন সচিবালয়ের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। সেই সংখ্যাও কেটে–ছেঁটে ৫৪–তে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে আনা।

হাভিয়ের মিলেই এবং লুই কাপুতো মনে করেন, তাঁদের সরকারের ১০টি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত আর্জেন্টিনার রাজস্ব–ঘাটতি কমাবে। তাঁদের মতে, এই ঘাটতিই দেশটির অতি উঁচু হারের মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের মূল কারণ। এসব পদক্ষেপ কত অর্থ সাশ্রয় করবে, সে সম্পর্কে মন্ত্রীরা অবশ্য কিছু বলেননি।

১০ পদক্ষেপ

লুই কাপুতো মঙ্গলবার যে ১০টি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন, সেগুলো হলো—
১. রাষ্ট্র খাতের যেসব কর্মচারীর চুক্তির মেয়াদ এক বছরের কম পুরোনো, সেসব চুক্তি নবায়ন করা হবে না।

২. জাতীয় সরকারের সব ধরনের বিজ্ঞাপন প্রকাশ আগামী এক বছর বন্ধ থাকবে।

৩. মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ১৮ থেকে ৯–এ নামবে। সচিবালয়ের সংখ্যা ১০৬ থেকে কমিয়ে ৫৪টি করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর স্তরে রাজনৈতিক যেসব পদ রয়েছে, তার ৫০ শতাংশের বেশি কমানো হবে। আর জাতীয় পর্যায়ে সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পদের সংখ্যা কমানো হবে ৩৪ শতাংশ।

৪. জাতীয় পর্যায় থেকে প্রদেশের কার্যালয়ে বদলি সীমিত করা হবে।

৫. নতুন করে কোনো নির্মাণকাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে না। ইতিমধ্যে অনুমোদন করা যেসব দরপত্রের অধীনে এখনো কোনো উন্নয়ন কাজ শুরু হয়নি, সেসব দরপত্র বাতিল করা হবে।

৬. জ্বালানি ও পরিবহনে ভর্তুকি কমানো হবে। বুয়েনস এইরেস মহানগর এলাকার পরিবহনের ভর্তুকি কমাতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে।

৭. সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে, তবে এ ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা খর্ব করা হবে। অর্থনীতি বিষয়কমন্ত্রী বলেছেন, যাঁদের এ ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তাঁরা সরাসরি এই সহায়তা পাবেন।

৮. আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার হবে ৮০০ পেসো। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের দাম হবে ৮০০ পেসো, যা আগে ছিল ৪০০ পেসোর মতো।

৯. আমদানির অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা বাতিল হবে। আমদানির জন্য আর অনুমতির প্রয়োজন হবে না, তবে এ–সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ও তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। লুইস কাপুতোর কথায়, ‘যে যা খুশি তা–ই আমদানি করতে পারবে। ফুল স্টপ।’

১০. শিশুদের জন্য সহায়তা তহবিলের আওতায় পরিবারকে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা দ্বিগুণ করা হবে। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ বাড়বে খাদ্য বিতরণের কার্ডের সংখ্যা।

কী সুবিধা পাবে আর্জেন্টিনাবাসী

লুই কাপুতোর ঘোষণার জন্য আর্জেন্টিনায় সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল। গত রোববার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় হাভিয়ের মিলেই বলেছিলেন, সরকারি খরচ ৫ শতাংশ কমানো হবে। তবে তিনি এ–ও বলেন, ‘রাষ্ট্র খরচ কমাবে এবং এর ধাক্কা বেসরকারি খাতের ওপর পড়বে না।’

তবে অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী যে ১০টি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন, তার বেশ কয়েকটির প্রভাব আর্জেন্টাইনদের পকেটের ওপর পড়বে। বিশেষ করে ডলারের দাম দ্বিগুণ করার বিষয়টি। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। দেশটিতে এখনই মূল্যস্ফীতির বার্ষিক হার ১৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

অন্য যে পদক্ষেপ মানুষকে সরাসরি ক্ষতি করবে, তা হলো জ্বালানি ও পরিবহনে ভর্তুকি হ্রাস। ভর্তুকির কারণে আর্জেন্টিনায় ট্রেন, বাস ও মেট্রোর ভাড়া অনেক কম। একই কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সস্তায় কিনতে পারে আর্জেন্টিনার মানুষ। এ খাতে রাষ্ট্রের বিপুল খরচ হয়, তবে মন্ত্রীরা এখনো জানাননি যে ভর্তুকি ঠিক কী পরিমাণ কমবে।

ডলারে সারচার্জ

লু্ই কাপুতো তাঁর সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে যেসব পদক্ষেপের কথা বলেছেন, তাতে এখনো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। যেমন ডলারের ওপর সারচার্জ কী হবে।

আর্জেন্টিনায় ডলারের বিভিন্ন দর রয়েছে। এমনকি আনুষ্ঠানিক মুদ্রাবাজারেও দুই দামে ডলার বিক্রি হয়। সারচার্জ দামের সঙ্গে যোগ করা হলে কখনো কখনো ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কালোবাজারের দামের চেয়েও বেশি হতে পারে।

আর্জেন্টিনার মানুষের আরেকটি উদ্বেগ হলো, ডলারের দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। যেহেতু পেসোর দাম কমেই চলেছে, তাই অনেকেই ডলারের দামের ভিত্তিতেই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম ঠিক করে থাকে। তাই ডলারের দাম যদি বেড়েই চলে, তাহলে এটা তাঁদের জন্যও জটিলতা তৈরি করবে।

সংবাদপত্রের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়া। গণমাধ্যমবিশেষজ্ঞদের ধারণা, এক বছরের জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ বন্ধ থাকার কারণে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাবে, চাকরি হারাবেন অনেকে।

নির্মাণশিল্পের ট্রেড ইউনিয়নগুলো মনে করছে, সরকারি পূর্ত কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আড়াই লাখ মানুষ কাজ হারাবেন।

কাপুতোর ঘোষণায় অবশ্য হাভিয়ের মিলেইয়ের দুটি প্রধান নির্বাচনী প্রস্তাব সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এই দুটি প্রস্তাব হলো, অর্থনীতির ডলারাইজেশন। অর্থাৎ ডলারকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া। তবে মন্ত্রী বলেন, তিনি ‘জরুরি পদক্ষেপ’ ঘোষণা করছেন এবং সরকার এখনো সমন্বিত অথনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেয়নি।

আর্জেন্টিনা সরকারের এই পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলে, সরকারের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য নেওয়া এসব সাহসী প্রাথমিক পদক্ষেপ সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশকে সুরক্ষা দেবে এবং একই সঙ্গে বিনিময় হারের ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।