ইউরোপে কি মন্দা আসছে

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে এবারের গ্রীষ্মকালে অদ্ভুত কিছু ঘটনা দেখা গেল, এক দিকে ভারী বৃষ্টিপাত ও আরেক দিকে দাবানল। মহাদেশের অর্থনীতিও চরম বিপরীত ঘটনার সম্মুখীন। মূল্যস্ফীতির হার চড়া, আগস্ট মাসে ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সঙ্গে ইউরোপের নীতিনির্ধারকেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশটির পিএমআই বা পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স কমে গেছে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এতে বোঝা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে।

১৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী বৈঠক। কিন্তু তার আগে নীতিনির্ধারকেরা স্ট্যাগফ্লেশনের (উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিন্তু নিম্ন প্রবৃদ্ধি) শঙ্কা করছেন। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দ বরাবরই মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেন। মূল্যস্ফীতির মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য নীতি সুদহার বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সোজা কথায়, মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে প্রয়োজন হলে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দা টেনে আনবে।

সমস্যা হচ্ছে, সেটা করতে গিয়ে ইসিবি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। ইউরো অঞ্চলের মূল্যস্ফীতি যুক্তরাষ্ট্রের মতোই অনমনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপে মূলত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে তা হয়েছে মূলত চাহিদার কারণে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্য ও জ্বালানি ছাড়া অন্যান্য পণ্যের মূল্যস্ফীতির সূচক কি আকাশ থেকে মাটিতে নামবে, এখন পর্যন্ত যা অনমনীয়ভাবে চড়া।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপও মন্দা এড়াতে পেরেছে। গত বছরের শেষ দিকে জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেললে অনেকেই যখন ধারণা করছিলেন যে ইউরোপ মন্দার কবলে পড়ল বলে, তখন বিভিন্ন দেশের সরকার উদার হাতে ভর্তুকি দিয়েছে। সেবা খাতের ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে, শিল্পোৎপাদনও কোভিড–উত্তর চাহিদার জোগান দিতে সচল ছিল।

কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি কমে গেছে। ইউরোপের আকাশেও কালো মেঘ। শিল্পোৎপাদন কমে গেছে। সরকার মানুষকে যে সহায়তা দিয়েছে, তা–ও কমে আসছে। মানুষের প্রকৃত আয় আগের জায়গায় ফেরেনি, জ্বালানির দামও সংকট শুরুর আগের পর্যায়ের চেয়ে বেশি। আগস্ট মাসে সেবা খাত সংকুচিত হয়েছে। সেবা খাতের অবস্থা আড়াই বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের মতো নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এখন তার প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে নির্মাণ খাতের উদাহরণ দিয়েছে ইকোনমিস্ট। এই খাত এমনিতেই সুদের সঙ্গে সম্পর্কিত, ফলে তারা নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফল টের পাচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ইনসলভেন্সি ঋণ পরিশোধের অসমর্থতা ৮ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে, ২০১৫ সালের পর যা এখন সর্বোচ্চ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের গবেষক অলিভার রাকাও বলেন, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে নীতি সুদহার বৃদ্ধির চূড়ান্ত ফল পাওয়া যাবে, অর্থাৎ সেই প্রান্তিকের পরিসংখ্যান প্রকাশিত হলে বোঝা যাবে, অর্থনীতিতে তার প্রভাব ঠিক কতটা।

বোঝা যাচ্ছে, পরিণতি খুব ভালো হবে না। তবে ইসিবি যতই সুদ বৃদ্ধি করুক না কেন, মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনা এখনো অনেক দূরের বিষয়।

দুটি বিষয় পণ্যমূল্যকে বিপরীত দিকে টানছে। প্রথমত, শ্রমবাজারের পরিস্থিতি—বেকারত্বের হার এখন রেকর্ড পর্যায়ে নেমে এসেছে। ইউরোপের কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়োগের সংখ্যা কমিয়ে দিলেও আপাতত গণহারে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা নেই। এর একটি কারণ হচ্ছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা শ্রমিকদের ছাড়তে চাইছেন না। মহাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে গেছে, ফলে এ মুহূর্তে ছাঁটাই করা হলে পরিস্থিতি আরও সঙিন হবে। ইউরোপে মজুরির হার বাড়ছে, যদিও তা মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়।

অন্যদিকে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে যাচ্ছে, সে কারণে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী। কোভিডের সময় মজুরি বৃদ্ধি শুরু হওয়ার আগেই মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়। ফলে কোম্পানিগুলোর মুনাফা বেড়েছে। এখন কোম্পানিগুলো যদি দেখে চাহিদা কমে যাচ্ছে, তাহলে এমন হতে পারে যে মজুরি বাড়বে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমবে। তেমন হলে মুনাফা কমে যাবে। ইতিমধ্যে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম দ্রুত হারে কমছে, আমদানি পণ্যের মূল্য কমছে।

এই দুই বিপরীতমুখী বলের মধ্যে কোনো একটি জয়ী হবে। এখন সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, আপাতত চাহিদা দুর্বল থাকবে। কারণ, সেবা খাতেও চাহিদার ঘাটতি শুরু হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে, ইউরো অঞ্চলের মূল্যস্ফীতি কমবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবারও নীতি সুদহার বাড়াবে তারা—৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হবে। ইকোনমিস্ট মনে করছে, নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা উচিত, তা না হলে অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।