মার্কিন মুদ্রার জোর কোথা থেকে আসে

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

বলা হচ্ছে, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডলারবাহিত। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই এর সূত্রপাত। করোনা মহামারি মোকাবিলায় মার্কিন সরকার সে দেশের জনগণকে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দিয়েছে। এ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে তারা যেমন বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তেমনি ফেডারেল রিজার্ভ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ছেপেছে। আর সেই ডলারের হাত ধরে মূল্যস্ফীতি দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র আগের কয়েক দশকের তুলনায় অনেক বেশি ডলার ছেপেছে—১৮ ট্রিলিয়ন বা ১৮ লাখ কোটি ডলার। অতিরিক্ত ডলারের কারণে সারা পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে মূল্যস্ফীতি। অনেকের অভিযোগ, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি বিদেশে রপ্তানি করেছে। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এসেছিল কোভিড বিপর্যয়। মন্দার কারণে গরিব দেশগুলোর রপ্তানি আয় কমে গিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আর তাতে বাড়ছে ডলারের দাম, বাড়ছে আমদানি করা পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সাধারণত দুটি দেশের মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য পুরোপুরি না হলেও অনেকটা নির্ভর করে তাদের আপেক্ষিক মূল্যস্ফীতির হারের ওপর। যে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি, সে দেশের মুদ্রার মূল্য অন্য দেশের মুদ্রার নিরিখে কমে যায়। মূল্যস্ফীতি মানে ক্রয়ক্ষমতার পতন, যে দেশে মূল্যস্ফীতি বেশি, সে দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা বেশি হারে কমছে। ফলে তুলনামূলকভাবে সেই দেশের মুদ্রার দামও কমে যাওয়ার কথা। টাকা-ডলার বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে কিন্তু উল্টোটা ঘটছে। বেশ কয়েক মাস হলো, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম। গত মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৯ দশমিক ১ শতাংশ। তাহলে মার্কিন ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়ছে কেন? টাকার তুলনায় ডলারের ক্রয়ক্ষমতা বেশি হারে কমা সত্ত্বেও ক্রেতারা টাকা বিক্রি করে ডলার কিনছেন কেন।

শুধু যে টাকার দাম পড়ছে তা-ই নয়, মার্কিন ডলারের নিরিখে ইউরো, পাউন্ড স্টার্লিং, জাপানি ইয়েন প্রতিটির দামই পড়ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির তুলনায় জাপানে মূল্যস্ফীতি অনেক কম, ইউরো অঞ্চলে কিছুটা কম, ব্রিটেনে মোটামুটি একই রকম।

এটা সত্যি, গত ৩০ বছরে পৃথিবীর উদীয়মান দেশগুলোর আয় যে হারে বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোর আয় সে হারে বাড়েনি। সবচেয়ে দর্শনীয় হচ্ছে চীনের প্রবৃদ্ধি। কিন্তু এই তালিকায় আরও দেশ আছে। এই দেশগুলোর আয় বৃদ্ধি ঘটেছে মূলত রপ্তানি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। দেশগুলো পণ্য রপ্তানি করে যে বিদেশি মুদ্রা পাচ্ছে, সেটা জমা পড়ছে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে। ফলে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুদ্রা হিসেবে ভান্ডারে রেখে দিলে সুদ পাওয়া যাবে না। একমাত্র মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে কিছু লাভ হতে পারে। কিন্তু সেই লাভ অনিশ্চিত, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য কমেও যেতে পারে। তার থেকে ঢের ভালো বিদেশি মুদ্রা দিয়ে কিছু আমানত কিনে রাখা, যার ওপর নিশ্চিত হারে সুদ পাওয়া যাবে।

উদীয়মান দেশগুলো যে নিরাপদ আমানত কিনতে চাইছে, সেটা জোগান দিচ্ছে উন্নত দেশগুলো। সমস্যা হলো, এক দিকে উদীয়মান দেশগুলোর অধিক আয় বৃদ্ধির কারণে নিরাপদ আমানতের চাহিদা বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোর আয় বৃদ্ধির হার কম হওয়ার কারণে নিরাপদ আমানতের জোগান ততটা বাড়ছে না। বস্তুত, নানা কারণে সেটা কমে আসছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমেরিকায় সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ফলে আমেরিকান ঋণপত্র আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিকটবর্তী দেশ ফ্রান্স ও জার্মানির ঋণপত্রগুলোকে আর ততটা নিরাপদ মনে করা হচ্ছে না। বাজারের এই মেজাজ পরিবর্তনের ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির ঋণপত্রগুলোর চাহিদা কমেছে এবং মার্কিন ঋণপত্রের চাহিদা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে মার্কিন ঋণপত্রের জন্য আবার একটা উদ্বৃত্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে। অন্য সব মুদ্রা বিক্রি করে দিয়ে ক্রেতারা মার্কিন ডলার কেনার চেষ্টা করছেন। ফলে অন্য মুদ্রাগুলোর নিরিখে মার্কিন ডলারের দাম বাড়ছে।

এর পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্যের সিংহভাগ এখনো মার্কিন ডলারে হয়। ফলে ডলারের চাহিদা চিরকালীন, অন্তত যত দিন বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না ওঠে।