আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্টের ‘শক থেরাপি’, থাকবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পেসো

আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়া শহর
ছবি: সংগৃহীত

আর্জেন্টিনায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডানপন্থী অর্থনৈতিক উদারবাদী হাভিয়ের মিলেই। সংকটে জর্জরিত দেশটির রাজনীতিতে তিনি অনেকটাই বাইরের মানুষ। তবে সংকট উত্তরণে তিনি যেসব অঙ্গীকার করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির খোলনলচে রীতিমতো বদলে যাবে। এককথায় তিনি অর্থনীতির জন্য ‘শক থেরাপি’র অঙ্গীকার করেছেন।

লাতিন আমেরিকার এই বিশাল দেশটির অর্থনীতি জটিল এক সমস্যায় পড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির হার তিন অঙ্কের ঘরে, অর্থাৎ ১০০ শতাংশের বেশি। অর্থনৈতিক মন্দা ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। পাশাপাশি বাড়ছে দারিদ্র্য। রাজনীতির মূল ধারার প্রতি সাধারণ মানুষের যে তীব্র ক্রোধ দেখা গেছে, সেই স্রোতে চড়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়েছেন ৫৩ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ মিলেই।

রয়টার্স জানিয়েছে, যা ধারণা করা হয়েছিল, দ্বিতীয় দফার ভোটে তার চেয়ে ভালো করেছেন হাভিয়ের মিলেই। সরাসরি দুজনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি পেয়েছেন ৫৬ শতাংশ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পেরন–পন্থী অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী সার্জিও মাসা পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট।

ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর হাভিয়ের মিলেই বলেন, ‘অধঃপতনের যে মডেল, তার সমাপ্তি ঘটেছে। আর পেছনে ফেরা যাবে না। আমাদের সামনে এখন বিপুল সমস্যা—মূল্যস্ফীতি, কাজের অভাব ও দারিদ্র্য। পরিস্থিতি খুবই সঙিন, এখন থেকে আর আধাআধি কোনো কাজ করা যাবে না।’

রাজধানী বুয়েনস এইরেসে হাভিয়ের মিলেইয়ের হাজারো সমর্থক গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আর স্লোগান দিয়ে বিজয় উৎসব পালন করেছেন। চিৎকার করে বলেছেন ‘তারা সবাই নিপাত যাক’ মিলেইয়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছিল এই স্লোগান। স্পিকারে বেজেছে রক গান। অতিমাত্রায় উত্তেজিত অনেকে আতশবাজিও পুড়িয়েছেন।

সালতা প্রদেশ থেকে আসা ২১ বছরের শিক্ষার্থী এফরেইন ভিভেরস বলছিলেন, ‘এই ঐতিহাসিক বিজয় উদ্‌যাপন করতে আমরা এসেছি। সত্যিই আমি উৎফুল্ল। মিলেই মানে হলো পরিবর্তন। ভালোর পথে পরিবর্তন। মাসাকে নিয়ে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। আমাদের ভবিষ্যৎ এখন ফিরে এসেছে।’

অনিশ্চিত পেসো

হাভিয়ের মিলেই অর্থনীতিতে ‘শক থেরাপি’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া, আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসো বাতিল করা, সরকারি ব্যয় কমানো এবং বড় রকমের সংস্কার কর্মসূচি চালানো, যা বেদনাদায়ক হতে পারে।

সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেসোর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। হাভিয়ের মিলেইয়ের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আর্জেন্টিনার অর্থনীতিকে ‘ডলারাইজ’ করা বা ডলারভিত্তিক করা। এর মানে হলো আর্জেন্টিনা পেসো বাতিল করে দিয়ে মার্কিন ডলারকে দেশের অভ্যন্তরীণ লেনদেনে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করবে।

যদি সেটাই ঘটে, তাহলে আর্জেন্টিনা এমন একটি পথে হাঁটবে, যে পথে এত বড় একটি দেশ এর আগে কখনো হাঁটেনি। আর্জেন্টিনার জন্য এটি ‘আননোন টেরিটোরি’ বা অজানা একটি অঞ্চল। আর্জেন্টিনার নিজস্ব মুদ্রানীতির লাগাম কার্যত চলে যাবে ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের হাতে।

তবে তা নিয়ে আর্জেন্টিনার মানুষ খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। ৩১ বছর বয়স্ক রেস্তোরাঁ কর্মী ক্রিস্টিয়ান রয়টার্সকে বলেন, ‘মিলেই হলেন আমাদের নতুন মানুষ। তিনি কিছুটা অপরিচিত। তাঁর নীতি কিছুটা ভয় জাগায়। কিন্তু পৃষ্ঠা ওলটানোর জন্য এখনই সবচেয়ে ভালো সময়।’

হাভিয়ের মিলেইর চ্যালেঞ্জ অনেক। সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে অর্থ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের একটি ঋণ নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। মূল্যস্ফীতি ১৫০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। পুঁজি নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে না।

আর্জেন্টিনার অনেক মানুষের কাছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল ‘কম ক্ষতিকর’ একজনকে বেছে নেওয়া। হাভিয়ের মিলেইর অর্থনৈতিক দাওয়াই যে বেদনার কারণ হবে, সেটা তাঁরা জানেন। কিন্তু অর্থনীতির যে সংকটে মাসা এবং তাঁর পেরন–পন্থী পার্টি দেশকে নিমজ্জিত করেছে, তার প্রতিও রয়েছে তীব্র ক্ষোভ। আর্জেন্টিনা এখন ঋণে ডুবে আছে, বিদেশ থেকে নতুন ঋণ পাচ্ছে না।

মিলেই বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। এসব তরুণ দেখেছেন তাঁদের দেশ এক সংকট থেকে আরেক সংকটে আরও বেশি তলিয়ে যাচ্ছে। ২০ বছর বয়সী আইরীন সোসা যেমনটা রয়টার্সকে বলছিলেন, ‘আমার মতো তরুণদের জন্য মিলেই হলেন ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে যা কিছু খারাপ ঘটেছে, তার সাথে ছিলেন মাসা।’

হাভিয়ের মিলেইয়ের জয় আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক মানচিত্র ও অর্থনীতির চালচিত্র বদলে দিতে পারে। সাথে প্রভাবিত করতে পারে শস্য, লিথিয়াম ও হাইড্রোকার্বনের ব্যবসা–বাণিজ্য। তিনি চীন ও ব্রাজিলের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, তিনি ‘কমিউনিস্টদের সাথে’ ওঠাবসা করতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে তিনি।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা প্রতিবেশী দেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে শুভকামনা জানিয়েছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তবে এ–ও আশা করেছেন যে আর্জেন্টিনাকে আবারও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেবেন হাভিয়ের মিলেই। তবে কলম্বিয়ার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো বলেছেন, মিলেইয়ের বিজয়ের দিনটি ওই অঞ্চলের জন্য ‘একটি বেদনার দিন’।

ডলার কেন

মিলেই আর্জেন্টিনার মুদ্রা হিসেবে ডলারকে বেছে নেওয়ার পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন তা হলো, ডলার পেসোর চেয়ে শক্তিশালী। আর চাইলেই ডলার ছাপানো যায় না, যেটা পেসোর ক্ষেত্রে করা যায়। লতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডোর ও এল সালভাদর অবশ্য ডলারকে তাদের মুদ্রা বানিয়েছে। এই দুই দেশের লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো।

সিএনএন জানিয়েছে, হাভিয়ের মিলেইয়ের পরিকল্পনা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁর সমালোচকেরা তাঁকে সতর্কও করে দিয়েছেন এই বলে যে খুব সোজাসাপটা পথে ভাবছেন তিনি। তাঁরা বলেছেন, অর্থনীতি ডলারভিত্তিক হয়ে গেলে সুদের হার বাড়ানোর মতো মুদ্রানীতির পদক্ষেপের মাধ্যমে তা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী সার্জিও মাসা ডলারাইজেশনের পরিকল্পনাকে ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে মিলেই সমর্থনও পেয়েছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাটো ইনস্টিটিউট বলেছে, এই পদক্ষেপ বাস্তবভিত্তিক কৌশল, দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে যার প্রয়োজন রয়েছে।