পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় এককাট্টা হয়েছে চীন-রাশিয়া

চীন ও রাশিয়ার পতাকা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভূরাজনীতি ও অর্থনীতির গতি বদলেছে। এ যুদ্ধের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও চীন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এমনকি চীনের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সীমা–পরিসীমা থাকবে না।

এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়েছে। দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্য রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে; রাশিয়া চীন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম কিনেছে এবং বিনিময়ে চীনের ক্রেতারা ছাড়কৃত মূল্যে রাশিয়ার জ্বালানি তেল ব্যবহার করছে। এ বাস্তবতায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ আবারও চীন সফরে গেছেন।

সিএনএনের সংবাদে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে মোট চারবার দুই নেতার সাক্ষাৎ হলো। শুধু তা–ই নয়, ২০১২ সালে সি চিন পিং ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে দুই নেতার মোট ৪৩ বার সাক্ষাৎ হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো ক্ষেত্রে এমন নজির দেখা যায় না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে পুতিনের ফোনে আলাপ হয়েছে মাত্র একবার।

রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা মূলত দেশটির যুদ্ধ করার সক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাশিয়া নানাভাবে এসব নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করছে। ২০২৩ সালে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এটা রুশ সরকারের তথ্য নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই তথ্য জানিয়েছে। যদিও আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দেশটির অর্থনৈতিক সংকোচন হয়েছিল।

২০২৪ সালেও রাশিয়ার ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইএমএফের পূর্বাভাস, চলতি বছর রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ; যদিও দেশটির সরকারের পূর্বাভাস, প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে, তা হলো, রাশিয়া কার সঙ্গে বাণিজ্য করবে, তার সেই অগ্রাধিকারে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। চীন তাদের বড় অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনা ছিল, ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটির দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে। কিন্তু তার আগেই ২০২৩ সালে তা ২৪ হাজার কোটি ডলারে উঠে যায়। এ পরিস্থিতিতে চীন এখন রাশিয়ার শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার। পুতিনের মুখপাত্র রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, চীন এখন রাশিয়ার শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার। এ অর্জনে ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিন পিং উভয়েই খুশি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানি কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে চীন। ২০২৩ সালে রাশিয়ায় ১১ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে চীন, অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় তাদের রপ্তানি বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। এই সময়ে রাশিয়া সৌদি আরবকে হটিয়ে চীনের বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী হয়ে ওঠে।

২০১৫ সালে রাশিয়া-চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের; ২০২০ সালে ছিল ১০ হাজার ৮০০ কোটি ডলার; ২০২২ সালে তা ১৯ হাজার কোটি ডলারের উন্নীত হয়। ২০২৩ সালে তা ২৪ হাজার কোটি ডলারে উঠছে; অর্থাৎ ২০১৫ সালের পর তাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় চার গুণ হয়েছে।

এখন চীন থেকে রাশিয়া মূলত যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও সেমিকন্ডাক্টর কিনছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ, এসব পণ্য ও উপকরণের দ্বৈত ব্যবহার হচ্ছে; অর্থাৎ এগুলো সামরিক ও বেসামরিক উভয় কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বদৌলতে রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

গত মাসে চীন সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। চীনের প্রতি তাঁর সতর্ক বার্তা, রাশিয়াকে দেওয়া এই সহযোগিতা বন্ধ না করলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ ব্যবস্থা নেবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গত সপ্তাহে ফ্রান্স সফরে গেলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনও চীনা প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে চাপ দেন। উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, যেসব পণ্যের দ্বৈত ব্যবহার হচ্ছে, রাশিয়ায় সেসব পণ্যের রপ্তানি কমাতে আরও ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, যেসব পণ্য যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর সরবরাহ কমাতে হবে।

বেইজিং সব সময়ে বলে আসছে, পশ্চিমাদের এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাধারণ বাণিজ্যিক লেনদেন হয়, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে রাশিয়ায় চীনের রপ্তানি কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্ভবত চীন কিছুটা পিছু হটেছে।