কীভাবে এল নয়টা-পাঁচটা কাজের সংস্কৃতি

মার্কিন কর্মসংস্কৃতি আবর্তিত হয় দিনে আট ঘণ্টা ও সপ্তাহে পাঁচ দিন—এই পদ্ধতিতে। তবে নিয়মটি হঠাৎ কিংবা বিশেষ আদেশে চালু হয়নি। কর্মক্ষেত্রের সময় নির্ধারণ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে, এমনকি ধর্মঘটও। এ নিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন গায়ক ডলি পার্টন ১৯৮০ সালে তো একটি গানই করেছেন ‘নাইন-টু-ফাইভ’ নামে।

অনেকে হয়তো মনে করেন, নয়টা-পাঁচটা কাজ করার নিয়ম অনেক আগে থেকে প্রচলিত। কিন্তু নিয়মটি চালু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অফিস সময়ের এ প্রথা শুরু হয়। তবে বাস্তবতা হলো, বহু বছর ধরে অফিস সময় নির্ধারণ নিয়ে নানা আলোচনা ও কার্যক্রমের ফল আজকের এই নয়টা-পাঁচটা অফিস সময়।

কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র আট ঘণ্টার কর্মদিবসে স্থায়ী হয়েছিল, তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সিএনএন অবলম্বনে লেখা এই প্রতিবেদনে।

সপ্তাহে ছিল ৭০ ঘণ্টার দীর্ঘ কর্মসময়

অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট হোপলসের জানান, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। ওই সময় লোকেরা সাধারণত সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করত। ফলে দৈনিক প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো তাঁদের।

এমনকি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও কর্মক্ষেত্রে এর চেয়ে অনেক বেশি সময় দেওয়ার উদাহরণ আছে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাতশিল্পে ব্লাস্ট ফার্নেসের শ্রমিকেরা সাধারণত সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা কাজ করতেন। অস্বাভাবিক এই দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে তাঁরা ধর্মঘট করেন, যদিও তা ব্যর্থ হয়। তবে এর চার বছর পর ইউএস স্টিল কোম্পানি কর্মীদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় নামিয়ে আনে।

গাড়ি কোম্পানি ফোর্ডের মালিক হেনরি ফোর্ড ১৯২৬ সালে প্রথম দৈনিক আট ঘণ্টা ও সপ্তাহে পাঁচ দিন কর্মসময়ের নিয়ম চালু করেন। ১৯২৯-১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র মহামন্দার কবলে পড়ে। তখন সে দেশে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যায়। তখন দিনে ছয় ঘণ্টা কাজের ধারণা প্রথম আলোচনায় আসে।

দৈনিক ছয় ঘণ্টা কাজের উদ্যোগ

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য উৎপাদন কোম্পানি কেলগের মালিক উইলিয়াম কিথ কেলগ ১৯৩০ সালে শ্রমিকদের বেতন কিছুটা কমিয়ে আট ঘণ্টা পালার পরিবর্তে ছয় ঘণ্টার পালা চালু করেন। কেলগ ভাবতেন, কর্মীদের আরও সময় দেওয়া একধরনের সামাজিক কল্যাণ। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ওই শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় ঘণ্টা কাজ করে আগের আট ঘণ্টার সমপরিমাণ আয় করতে শুরু করেন।

কেলগের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফলে ছয় ঘণ্টার কর্মদিবস প্রণয়নের জন্য জনমত তৈরি হতে থাকে। পরবর্তী সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার একটি বিল অস্থায়ীভাবে সিনেটে পাস হয়। তবে সেটি হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে আটকে যায়।

১৯৩৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট জাতীয় শিল্প পুনরুদ্ধার আইনে সই করেন। আইনে ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা কর্ম সপ্তাহ চালুর নিয়ম করা হয়, যদিও এর দুই বছর পর দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আইনটি অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।

অবশেষে আট ঘণ্টা ও পাঁচ দিনের নিয়ম চালু

আদালত জাতীয় শিল্প পুনরুদ্ধার আইনট অবৈধ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতা ও ইউনিয়নগুলো আরও ভালো শ্রম পরিস্থিতির জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩০–এর দশকের শেষের দিকে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট নামের একটি আইনে সই করেন।

ওই আইনের মাধ্যমেই প্রণীত হয় আজকের দৈনিক আট ঘণ্টা ও সপ্তাহে পাঁচ দিনের কাজের সময়সীমা। একই সঙ্গে নতুন আইনে নিয়োগকর্তারা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করালে কর্মীদের ওভারটাইম দেওয়ার বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া আইনে একটি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও শিশুশ্রম সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়।

মূলত ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্টের মাধ্যমে আট ঘণ্টা কর্মসময়ের নিয়মটি যুক্তরাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্বের অন্যান্য দেশও এটি অনুসরণ করতে শুরু করে।