টিকটকের চীনা মালিক সম্পর্কে কী জানা যায়

টিকটকরয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একটি বিল পাস হয়েছে, যে বিলের মধ্য দিয়ে টিকটকের চীনা মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সকে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হয়ে যেতে পারে টিকটক।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জমানার পর যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের বিরুদ্ধে এত বড় ব্যবস্থা আর নেওয়া হয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে টিকটকের বাজারমূল্য ছিল ২৬৮ বিলিয়ন বা ২৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

বাইটড্যান্স কী

টিকটকের মূল মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স। এই কোম্পানি এত ঘন ঘন বাজারে অ্যাপ ছাড়ে যে তার ডাকনাম হয়ে গেছে অ্যাপ ফ্যাক্টরি। ২০১২ সালে সফটওয়্যার প্রকৌশলী ঝ্যাং ইমিং চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে এই কোম্পানি চালু করেন।

বাইটড্যান্সকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অ্যালগরিদম কোম্পানি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাদের তৈরি টিকটক, ডৌয়িন ও টৌটিয়াওয়ের মতো অ্যাপ গ্রাহকের চাহিদা বুঝে কাজ করতে পারে; সে জন্য গ্রাহকদের কাছে এগুলোর আবেদন আছে।

বাইটড্যান্সের প্রথম জনপ্রিয় অ্যাপ ছিল টৌটিয়াও-২০১২ সালে চালু হওয়া অ্যাপটি মূলত সংবাদ সংগ্রহমূলক অর্থাৎ এই অ্যাপের অ্যালগরিদম গ্রাহকদের পছন্দমতো সংবাদ এক জায়গায় জড়ো করে।

টিকটকের সহকারী অ্যাপ ডৌয়িন ২০১৬ সালে চীনে চালু হয়। চালু হওয়ার পরপরই এই অ্যাপ দারুণ সফল হয়; চালু হওয়ার এক বছরের মধ্যে অ্যাপটির ব্যবহারকারী ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়।

২০১৭ সালে ডৌয়িনের আন্তর্জাতিক রূপ হিসেবে টিকটক চালু হয়। বাইটড্যান্স যদিও বলে যে এই অ্যাপ দুটি ভিন্ন পণ্য হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল, তাদের লোগো এক এবং ইন্টারফেসের নকশাও এক।

প্রতিষ্ঠাতা, সিইও ও বড় বিনিয়োগকারী

বাইটড্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা ঝ্যাং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় প্রদেশ ফুজিয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিয়ানজিনের নানাকাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলে পড়াশোনা করেছেন। বাইটড্যান্স প্রতিষ্ঠা করার আগে তিনি মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করেছেন, যদিও তিনি মাইক্রোসফটে বেশি দিন কাজ করেননি।

বাইটড্যান্সের শুরুর দিকে ঝ্যাং মূলত বেইজিংয়ে টৌটিয়াও ও ডৌয়িনের পেছনেই বেশি সময় দিয়েছেন। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির সময় থেকে তিনি মূলত দেশের বাইরেও বেশি সময় ব্যয় করছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে রয়টার্স জানতে পেরেছে, ঝ্যাং এখন মূলত সিঙ্গাপুরভিত্তিক হয়ে গেছেন; সেখান থেকেই কাজকর্ম করছেন।

২০২১ সালে ঝ্যাং বাইটড্যান্সের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন; দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন কোম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী লিয়াং রুবোকে। দায়িত্ব গ্রহণের সময় ঝ্যাং ইমিং বলেছিলেন, আদর্শ ব্যবস্থাপক হওয়ার জন্য যে সামাজিক দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা তাঁর নেই। ফলে তিনি পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে বসে কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন নিয়ে কাজ করবেন।

গত বছরের মে মাসে টিকটকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, টিকটকের ৬০ শতাংশ মালিকানা কার্লাইল গ্রুপ, জেনারেল আটলান্টিক ও সাসকিউহানা ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে; ২০ শতাংশ শেয়ার কর্মীদের এবং বাকিটা ঝ্যাংয়ের হাতে।

তবে ঝ্যাং প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরও বাইটড্যান্সের পর্ষদে ৫০ শতাংশ ভোটাধিকার তাঁরই হাতে রয়েছে।

চীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক

চীনে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিসহ বিভিন্ন করপোরেটের ক্ষেত্রে যা ঘটে, বাইটড্যান্সের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে। ২০১৪ সালে বাইটড্যান্সে কমিউনিস্ট পার্টির একটি শাখা খোলা হয়; এরপর বাইটড্যান্সের স্থানীয় এক সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে চীন সরকার ১ শতাংশ মালিকানা গ্রহণ করে। একই সঙ্গে চীন সরকার কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেও স্থান পায়।

মূলত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় বাইটড্যান্স মার্কিন সরকারের কোপানলে পড়ে। ২০২০ সালে মার্কিন সরকার এক নির্বাহী আদেশ দিয়ে টিকটককে কোম্পানির মার্কিন সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। তবে আদালতের হস্তক্ষেপে মার্কিন সরকারের সেই প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই চেষ্টার পর টিকটক কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেসব প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন দরকার, সেই তালিকা সংশোধন করে কোম্পানিটি। যদিও এতে তাদের অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আসে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা টিকটকের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। টিকটকের মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য বেইজিংয়ের কাছে চাওয়া যেতে পারে বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা। কিন্তু টিকটক বলেছে, তারা এ ধরনের অনুরোধ পায়নি বা মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারের হাতে তুলে দেয়নি।

তবে এই উদ্বেগ আমলে নিতে টিকটক মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য সে দেশেই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সে জন্য তারা মার্কিন কোম্পানি ওরাকলের সঙ্গে চুক্তি করে; ২০২০ সাল থেকে তারা মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য সে দেশেই সংরক্ষণ করছে।

এবার যে বিল পাস হয়েছে, টিকটক তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।