কেন পিছিয়ে পড়ছে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানি

ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১০-এর দশক ছিল জার্মানির সোনালি সময়। ২০০০-এর দশকে শুরু হওয়া কর্মসংস্থানের ধারা পরের দশক অর্থাৎ ২০১০-এর দশকে এসে পূর্ণতা পায়। সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডারের আমলে যে সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়, তার বদৌলতে ২০০৭-০৯ সালের আর্থিক সংকট থেকেও বেঁচে যায় জার্মানি। সেই সঙ্গে চীনের মতো দেশে উন্নত ও তৈরি পণ্য এবং উদীয়মান বাজারে জার্মানির পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর দশকের শেষাবধি পর্যন্ত জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোট ২৪ শতাংশ, যেখানে ব্রিটেনের হয়েছে ২২ শতাংশ, ফ্রান্সের হয়েছে ১৮ শতাংশ। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রেক্সিটের মতো জনতুষ্টিবাদী ধারাও দেশটিতে ছুঁতে পারেনি।

জার্মানির সামাজিক মডেলের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইউনিয়ন ও শ্রমিকের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক; সেই সঙ্গে সমবায়ী ফেডারেলিজমের কারণে প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের গভীরে বিস্তৃত। এসব দেখে পর্যবেক্ষকেরাও বিস্মিত হতেন। এমনকি জার্মানির ফুটবল দলও বিশ্বকাপ জেতে।

কিন্তু ২০২০-এর দশকে এসে সব যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। দেশটির ফুটবল দলের অবস্থাও খারাপ। দেশটিতে অতি ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তাদের জনসমর্থন ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, জার্মানি যে অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে গর্ব করত, সেই মডেল এখন জনগণের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি ও সেবার নাগাল দিতে পারছে না।

বিষয়টি শুধু ইউরোপের যুদ্ধ ও চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ার কারণে ঘটছে তা নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের পূর্বাভাস, চলতি বছর জি–৭ বা ধনী দেশগুলোর মধ্যে কেবল জার্মানির অর্থনীতি সংকুচিত হবে।

দেশটি সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসও খারাপ। তিন ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে জার্মানি। প্রথমত, জার্মানির শিল্প খাত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদের কবলে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, নিট শূন্য কার্বন নিঃসরণের দিকে জার্মানির যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত, দেশটির তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, জার্মানি রাষ্ট্র এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথভাবে প্রস্তুত নয় বলেই মনে হচ্ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ইউরো অঞ্চলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হয়েছে। জার্মানির নির্মাণ খাত ও ব্যবসায়িক পরিবেশে ইতিমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তারপরও অনেক দেশের চেয়ে জার্মানিতে নীতি সুদহারের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাহ্যিক খাতের কারণে।

ইউরোপের অন্যান্য অর্থনীতির চেয়ে জার্মানি চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। চীনের অর্থনীতি যেভাবে গতি হারাচ্ছে, তাতে জার্মানিও আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছর গ্যাসের দাম যেভাবে বেড়েছিল, তার প্রভাব এখনো অনুভূত হচ্ছে। বাজারের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে আগামী কয়েক বছর গ্যাসের দাম প্রাক্–মহামারি পর্যায়ের দ্বিগুণ থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। গত বছর জ্বালানি ঘন শিল্পের উৎপাদন যেভাবে কমেছে, তার জের এখনো আছে। দেশটির ভোক্তারাও ভুগছেন; প্রকৃত মজুরি কেবল বাড়তে শুরু করেছে, ২০১৫ সালের পর যা কখনোই এতটা নিচে নামেনি।

এই পরিস্থিতিতে কী করা হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন জার্মানির মন্ত্রীরা। দেশটির সামাজিক গণতান্ত্রিক জোট সরকারের অংশীদার ‘দ্য গ্রিনস’ মনে করছে, শিল্পোৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ ও সামাজিক গৃহায়ণে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করা উচিত। তবে জার্মান কাউন্সিল অব ইকোনমিক এক্সপার্টের প্রধান মনিকা স্নিটজার মনে করেন, নির্মাণ খাত দুর্বল থাকায় সরকার বরং নিজে কাজ করাতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত এফডিপি চায়, সরকার কর হ্রাস করে যেন বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে।

কিন্তু এই উভয় পরিকল্পনার মধ্যে যেটিই বাস্তবায়িত হোক না কেন, তাতে সরকারের ঘাটতি আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় ঋণসীমার মতো জার্মানির সরকারের বাজেটঘাটতিরও সীমা আছে। সেই সীমা পাশ কাটাতে তাদের হিসাবরক্ষণের কৌশল ব্যবহার করতে হবে।

তবে দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, জার্মানি সরকার যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, সমস্যা আরও কিছুকাল থাকবে। দেশটির পারচেজিং ম্যানেজার্স ম্যানুফ্যাকচারিং ইনডেক্স বা পিএমআই সূচক কোভিডের শুরুর সময়ের পর সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে। ব্যবসায়ীদের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত—আগামী ছয় মাসের পরিস্থিতি নিয়ে প্রত্যাশার পারদ নিম্নমুখী।

আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। তারা বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে জার্মানির প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৮ শতাংশ, ইউরোপের আরেক বৃহৎ অর্থনীতি যুক্তরাজ্যেরও একই অবস্থা। এই সময়ের মধ্যে ফ্রান্সের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ১০ শতাংশ; নেদারল্যান্ডসের ১৫ ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ শতাংশ।

জার্মানির জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভূরাজনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ উভয়ই চায়, বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা যেন এককভাবে কোনো অপশ্চিমা দেশের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না পড়ে, বিশেষ করে চীন। এখন তারা মরিয়া হয়ে চীনের ওপর একক নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নতুন এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার কারণে জার্মানি লাভবান হতে পারে। যেমন অনেক কোম্পানি এখন চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে আনতে চাইছে, বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো নতুন পণ্য উৎপাদনের জন্য তারা নতুন জায়গা খুঁজছে।

বিশ্বের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি টেসলা ইতিমধ্যে বার্লিনের কাছে একটি কারখানা খুলেছে। এই কারখানাকে তারা জার্মানির বৃহত্তম গাড়ি কারখানা বানাতে চায়। অন্যদিকে ইন্টেল জার্মানির মধ্যাঞ্চল্যে ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করে কারখানা স্থাপনে সম্মত হয়েছে। এই আগস্ট মাসেই টিএসএমসিসহ আরও তিনটি চিপ কোম্পানি জার্মানির ড্রেসডেন শহরে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ইউরো বিনিয়োগ করে চিপ কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে।

তবে এসব বিনিয়োগ জানতে জার্মানিকে যথেষ্ট ভর্তুকি দিতে হবে। অনেক দেশ এখন বিনিয়োগ আনতে এভাবে ভর্তুকির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে তখন প্রশ্ন উঠবে, জনগণের করের অর্থ এভাবে ব্যয় করা কতটা সংগত।

এ ছাড়া পশ্চিমের বাইরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক হ্রাসের কারণে জার্মানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউরোপের মধ্যে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গেই স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের সঙ্গে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের বাণিজ্য তাদের সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশের সমপরিমাণ। সে কারণে ২০২১ সালে ওইসিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্ব বাণিজ্যে চীন একঘরে হয়ে পড়লে জার্মানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে জার্মানিতে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি, সেটিও বড় সমস্যা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। আরেকটি বিষয় হলো, জার্মানির মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেননি; বরং তাঁরা এখনো নগদ লেনদেনে বেশি আগ্রহী। অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এটাও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ইকোনমিস্ট বলছে, সমস্যা অর্থ নিয়ে নয়; বরং প্রশাসনের। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশটির সরকারের সদিচ্ছা। জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তেমন একটা সাহস দেখাচ্ছেন না; বরং তিনি ছোটখাটো কিছু নীতিগত পরিবর্তন নিয়েই ব্যস্ত।

এর আগে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে জার্মানি এমন বিপদে পড়েছিল। তখন দ্য ইকোনমিস্ট জার্মানিকে ইউরোপের ‘রোগাক্রান্ত মানুষ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। তখন জার্মানির রাজনীতিকেরা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচিতে হাত দেন, যদিও এর জন্য তাঁদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এরপর বিশ্ব–অর্থনীতির অনুকূল পরিবেশ ও উদীয়মান বাজারের ওপর ভর করে জার্মানি ঘুরে দাঁড়ায়—একসময় ইউরোপসহ পশ্চিমের অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়েও যায়।

কিন্তু এখন সে রকম কোনো সম্ভাবনা বা ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না, সেটিই বড় সংকট।