ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষতি করেছে, নাকি উল্টো চাঙা করেছে

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন অনেক বিশ্লেষকই ধারণা করেছিলেন, এতে রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে যাবে। দেশটির অর্থনীতি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে বলেও ধারণা করা হয়েছিল। খবর দ্য গার্ডিয়ানের

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছে, ২০২২ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ২ শতাংশের সামান্য বেশি সংকুচিত হতে পারে। অথচ ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণের প্রথম বছরে রাশিয়ার অর্থনীতি এর চেয়ে বেশি হারে সংকুচিত হয়েছিল। যদিও যুদ্ধের সময় জিডিপির আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান দিয়ে একটি দেশের প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

আজ মঙ্গলবার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রকাশ করবে আইএমএফ। সেখানে বিভিন্ন দেশসহ রাশিয়ার অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বলেছে, ২০২২ সালে ২ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার পর ২০২৩ সালে রাশিয়ার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এরপর ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশ। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, সাড়ে ১৪ কোটি মানুষের দেশ রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ চাঙা।

তবে যুদ্ধের সময় নিছক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব করা যথাযথ হয় না, এমন কথাও বলছে কিছু গবেষণা সংস্থা। যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ (সিইপিআর) বলছে, সামরিক ব্যয় প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে গত বছর রাশিয়ার অর্থনীতিতে সংকোচনের হার স্রেফ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ও নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মিখাইল মামোনোভ যুদ্ধরত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব না করার পক্ষে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ সময় সাধারণত দাপ্তরিক হিসাব কিছুটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। তাঁর মতে, রাশিয়ায় মানুষের দোকানে কেনাকাটা ১০ শতাংশর মতো কমে গেছে, অর্থাৎ প্রকৃত অর্থনীতির নাটকীয় সংকোচন হয়েছে।

সিইপিআরের সমীক্ষায় যুক্ত ছিলেন ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ এড্রিয়ান স্কিমথ ও গ্রনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ হানা সাকো। তাঁরা নিছক ভোক্তা ব্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বেসরকারি খাতের তৎপরতা পরিমাপ করতে অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিমাপের পদ্ধতি বের করেছেন। ১৫টি উৎস থেকে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যেমন গুগল অনুসন্ধান, বিমান সংস্থার টিকিট কেনাবেচা ও বাড়ির দামের তথ্য।

ব্রিটেনের সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, এর ভিত্তিতে দুই অর্থনীতিবিদের মতো হচ্ছে, গত বছর দাপ্তরিক পরিসংখ্যানের চেয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেক বেশি সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে অসামরিক কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হলে পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়।

এড্রিয়ান স্কিমথ ও হানা সাকোর মতো, ২০২২ সালে রাশিয়ার ব্যক্তি খাতের ভোগ ৪ শতাংশ কমেছে, যদিও দাপ্তরিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই কমার হার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও তাঁরা মনে করেন, সামরিক ব্যয় পুরোপুরি বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ হিসাব করা কঠিন।

তবে ভোগ কমার পেছনে নিষেধাজ্ঞার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও কাজ করেছে বলে মনে করেন এই দুই অর্থনীতিবিদ। ভোগ কমার পেছনে নিষেধাজ্ঞার কিছু প্রভাব আছে বলেই মনে করেন তাঁরা।

এ ছাড়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষের মধ্যে ভোগের প্রবণতা কমে। এ সময় মানুষ সাধারণত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। ফলে গত বছর রাশিয়ার নাগরিকদের সঞ্চয়ের হার ছিল উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি—৩২ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাজ্যের মানুষের সঞ্চয়ের হার ছিল ৯।

এ ছাড়া কিছু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় বলে মনে করেন এড্রিয়ান স্কিমথ ও হানা সাকো। যেমন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার মোট পণ্য আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ কম ছিল। সেই সঙ্গে এ সময়ে প্রযুক্তি আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ।

এ ছাড়া গত বছর রাশিয়ায় গাড়ি উৎপাদন কমেছে ৬৭ শতাংশ, খননযন্ত্রের উৎপাদন কমেছে ৫৩ শতাংশ, টেলিভিশন রিসিভার যন্ত্র উৎপাদন কমেছে ৩৬ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন সহায়ক যন্ত্রপাতিতে আমদানি নিষেধাজ্ঞা থাকায় উৎপাদন নিকট ভবিষ্যতে আরও কত কমবে, তার নিশ্চয়তা নেই বলেই মনে করেন দুই অর্থনীতিবিদ।

আরেক দিকে যুদ্ধে নিহত ও আহত সেনাদের পরিবারের ভরণপোষণ দিতে রাশিয়ার সরকারের বিপুল ব্যয় হচ্ছে। এতে সরকারের ভান্ডারে টান পড়তে শুরু করেছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকনীতি সুদহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে। এটা আরও অনেক দিন থাকবে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা। সেই সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বিপুল সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যান্য খাতের বিকাশ ব্যাহত হবে।

গত বছর তেলের দাম বাড়ার কারণে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মানও বেড়েছিল। সম্প্রতি তা আবার পড়ে গেছে। গত সপ্তাহে রুবলের মান গত এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এতে আমদানির ব্যয় বাড়ছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, তেল বিক্রির রাজস্ব কমে যাওয়া, রুবলের দরপতন, বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, সর্বোপরি মানুষের মনের আতঙ্ক—এসব রাশিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ফলে ২০২৪ সালের পর যুদ্ধ করার সামর্থ্য কমে আসবে রাশিয়ার।

ইউক্রেনের কী অবস্থা

ইউক্রেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। স্বাভাবিকভাবে তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। আইএমএফ বলছে, রাশিয়ার আগ্রাসন ইউক্রেনের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ কারণে গত বছর দেশটির জিডিপি প্রায় ৩০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের বেশির ভাগ মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস হয়েছে এবং দারিদ্র্য বেড়েছে।

সম্প্রতি ইউক্রেনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার ৫৬০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে আইএমএফ।

আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ এক বিবৃতিতে বলেছেন, চার বছর মেয়াদি নতুন এ কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, ইউক্রেনে অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সংস্কার। আইএমএফ অনুমোদিত এই আর্থিক সহায়তার মধ্যে ২৭০ কোটি ডলার খুব দ্রুতই পেয়ে যাবে ইউক্রেন। বাকি অর্থ দেওয়া হবে আগামী চার বছরে।