টেইলর সুইফট, বার্বি আর বিয়ন্সে—নারীরা যেভাবে অর্থনীতিকে চাঙা রাখছেন

একবিংশ শতাব্দী যদি নারীদের হয়, তাহলে ২০২৩ সালকে বিবেচনা করা যেতে পারে নারীদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের বছর হিসেবে। গত বছর দেশে দেশে নারীদের ব্যয় এত বেশি ছিল যে বড় বড় শহর তো বটেই, একটি দেশের পুরো অর্থনীতিকেই তা প্রভাবিত করেছে। সংগীতজগৎ থেকে থেকে সিনেমা—সব অঙ্গনের তারকা নারীরাই এ ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। মার্কিন গণমাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।

মার্কিন গায়িকা ও অভিনেত্রী বিয়ন্সে নোয়েলসের কথাই ধরা যাক। গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কনসার্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে রেনেসাঁ ওয়ার্ল্ড ট্যুর করেছিলেন তিনি। শুরুটা হয়েছিল মে মাসে সুইডেনে, পরপর দুটি কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে, বিয়ন্সে নোয়েলস ওই সময় এককভাবে সুইডেনে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক। বিয়ন্সের কনসার্ট উপলক্ষে হাজারো ভক্ত হাজির হন সুইডেনে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ রাজধানী স্টকহোমে আসেন তাঁর গান শুনতে। তখন অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় হোটেলভাড়া, রেস্তোরাঁর খাবারসহ বিনোদনের বিভিন্ন খাতের ব্যয় আকাশচুম্বী হয়ে যায়। সুইডেন সরকার জানায়, বিয়ন্সের কনসার্ট আগের মাসের তুলনায় দেশটিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তী, অর্থাৎ জুন মাসেই মূল্যস্ফীতি আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে।

ডেনমার্কের ডানস্কা ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল গ্রান বলেন, ‘কোনো একক ইভেন্টের জন্য এ ধরনের মূল্যস্ফীতি বেশ আশ্চর্যজনক। আমি এমনটা আগে দেখিনি।’ নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, বিয়ন্সের বৈশ্বিক কনসার্ট মার্কিন অর্থনীতির জন্য আনুমানিক ৪৫০ কোটি ডলার আয় করেছে, যা ছিল ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের আয়ের চেয়ে বেশি।

সিনেমা তথা বক্স অফিসের হিসাবেও নারীরা ২০২৩ সালে ইতিহাস গড়েছেন। গত বছর জুলাইয়ে মুক্তি পায় বহুল আলোচিত সিনেমা ‘বারবি’। অল্প দিনের মধ্যেই এটি হ্যারি পটারকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ও বিশ্বব্যাপী বছরের সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। ‘বারবি’ দেখার জন্য গোলাপি পোশাক পরা তরুণীদের ঢল নামে সারা বিশ্বের সিনেমা হলগুলোতে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নানা উপলক্ষে মেয়েরা যখন ব্যয় করতে শুরু করেন, তখন অর্থনীতিও ফুলেফেঁপে ওঠে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভও সেই প্রভাব আঁচ করতে পারে।

ভোক্তাদের যত উন্মাদনা

ভোক্তাদের আচরণের ওপর সেলিব্রিটিদের প্রভাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে কখনো কখনো তা অন্য স্তরে উঠে যায়। মার্কিন গায়িকা টেইলর সুইফট এ ক্ষেত্রে যেন সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে টেইলর সুইফটের গান ‘ইউ আর অন ইওর ওউন, কিড’ প্রকাশ পায়। গানটির মধ্যে একটি বাক্য ছিল এমন, ‘সো মেক দ্য ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেটস, টেক দ্য মোমেন্ট অ্যান্ড টেস্ট ইট।’

গানটি প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের কারুশিল্পের চেইনশপ মাইকেলসের স্টোরগুলোতে হঠাৎ বিশেষ ধরনের ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেট’ বিক্রির ধুম পড়ে যায়। মাইকেলস জানিয়েছে, অনেক স্থানে এই ব্রেসলেটস বিক্রি ৫০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ডিউক ইউনিভার্সিটির ব্যবসায়িক অর্থনীতির অধ্যাপক এড টিরিয়াকিয়ান বলেন, এ ঘটনা নারীর সাধারণ ক্রয়ক্ষমতার একটি প্রমাণ।

গায়িকা বিয়ন্সে নোয়েল গত বছর তাঁর এক অনুষ্ঠানে ভক্তদের সিলভার আউটফিট পড়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান এটসির ছোট ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের পোশাক আকাশচুম্বী দামে বিক্রি করেছিল। একইভাবে ‘বারবি’ সিনেমা প্রকাশের পর নারীদের জন্য গোলাপি রঙের পোশাক ও পণ্য বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।

২০২৩ সালের মার্চে টেইলর সুইফটের ‘দ্য ইরাস ট্যুর’ নামের ১৫১টি বৈশ্বিক কনসার্টের যাত্রা শুরু হয়। গত বছর এর মাত্র অর্ধেক পরিমাণ কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়; আর তাতেই ইতিহাসে এক ট্যুর থেকে প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলার রাজস্ব আয় হয়। এই কনসার্টের বাকি পর্বগুলো আয়োজিত হবে চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এড টিরিয়াকিয়ান বলেন, টেইলর সুইফটের ১৫১টি কনসার্টের মোট অর্থনৈতিক মূল্য ৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, সুইফটিসরা (টেইলর সুইফটের ভক্তরা এ নামেই পরিচিত) এই গায়িকার কনসার্টে অংশ নিতে ভ্রমণ, হোটেলে থাকা, খাবার ও পোশাকের জন্য গড়ে ১ হাজার ৩০০ ডলার করে ব্যয় করেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে।

আরও মজার তথ্য দেওয়া যাক। টেইলর সুইফট যখন কানসাস সিটি চিফসের ফুটবল তারকা ট্র্যাভিস কেলসির সঙ্গে প্রেম শুরু করেন, তখন এই দলের ম্যাচগুলোতে দর্শকসংখ্যা হঠাৎ ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। হার্ভার্ড থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন টেইলর সুইফটের ওপর পাঠদানের সুযোগ দিচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়্যারে টেইলর সুইফটের কর্মজীবনের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি–বিষয়ক একটি কোর্সও রয়েছে।

বিশ্বনেতারাও চান টেইলর সুইফটকে

দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের নেতারাও তাঁদের দেশে পারফর্ম করার জন্য সময়ে সময়ে টেইলর সুইফটকে অনুরোধ করেছেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন যে এর ফলে তাঁদের দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে। যেমন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত বছরের জুলাইয়ে এক্সে (টুইটারে) দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, ‘আমি জানি কানাডার শহরগুলো আপনাকে পেতে পছন্দ করবে। আমরা আশা করি, শিগগিরই আপনাকে দেখতে পাব।’

সুইফটকে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক।

অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি

বিভিন্ন হিসাব দেখাচ্ছে, নারীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করছেন। তবে পুরুষদের তুলনায় এর পরিমাণ এখনো অনেক কম বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, নারীরা আজও অনেক বাধা ভাঙতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫০০টি কোম্পানির মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে নারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চতর পদে নারীদের কমই দেখা মেলে।

তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এটাও দেখাচ্ছে, নারীরা আগের তুলনায় বেশ অগ্রগতি অর্জন করছেন। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা অর্থ ব্যয় করছেন। এ জন্য তাঁরা বেছে নিচ্ছেন বিয়ন্সে কিংবা টেইলর সুইফটের কনসার্টের মতো আয়োজনকে। এসব আয়োজনে তাঁরা পরিজন বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেন এবং বড় ধরনের কেনাকাটাও করেন।

অনুবাদ করেছেন: শফিকুল ইসলাম