হঠাৎ তেলের উৎপাদন কমানোয় রাশিয়া যেভাবে লাভবান হচ্ছে

জ্বালানি তেল
ছবি: সংগৃহীত

তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক এবং এর সহযোগী দেশগুলো – যা ওপেক প্লাস হিসাবে পরিচিত – হঠাৎ করে তেলের উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দেওয়ার পর বিশ্ববাজারে বেড়ে গেছে অপরিশোধিত তেলের দাম।

তেলের দাম বাড়লে বিশ্বের বড় বড় তেল কোম্পানিগুলোর যেমন লাভ, তেমনি রাশিয়ারও লাভ। খবর ইকোনমিক টাইমসের।

সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহৃত হয়। ফলে তেলের উৎপাদন মাত্র ১ শতাংশ কমানো হলেও দামে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু বছরের শেষভাগে বিশ্ব মন্দার আশঙ্কায় তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে। একপর্যায়ে তা যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে আসে। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে।

ওপেক মনে করছে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারের নিচে নামলে তাদের অসুবিধা। এতে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। দাম এর ওপরে রাখতেই তাদের এ উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে আদতে রাশিয়ারই লাভ। ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাতে তাদের অর্থ খরচ হচ্ছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনিতেই দেশটির অর্থনীতি অবরুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে তার পক্ষে যুদ্ধের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে তেল বিক্রির অর্থের বিকল্প নেই।

পশ্চিমারা রাশিয়ার জ্বালানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও অনেক দেশ মস্কোর কাছ থেকে তেল-গ্যাস কিনছে। এ থেকে রাশিয়া যেন বেশি মুনাফা করতে না পারে, সে জন্য জি-৭ রাশিয়ার তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার বেঁধে দিয়েছে।

জ্বালানির বাজারদর বেশি থাকলে রাশিয়ার পক্ষে দর-কষাকষির সুবিধা হয়। সে জন্য তাদের সহায়তা করতে ওপেক উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগেই রাশিয়া জানিয়েছিল, তারা দৈনিক তেল উৎপাদন পাঁচ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত কমাবে। সেই সিদ্ধান্তে তারা আরও কিছুদিন অটল থাকবে বলেই জানিয়েছে। এরপর ওপেক এ উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দিল।

এবারের তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণার আরেকটি তাৎপর্য হলো, তেলের চাহিদা এখন বাড়তির দিকে। গত দুই বছর ওপেক উৎপাদন হ্রাস করেছে, কিন্তু তখন চাহিদা এত বেশি ছিল না। গত বছরের বড় একটা সময় চীনের অধিকাংশ অঞ্চলে লকডাউন ছিল। তাদের চাহিদা ছিল কম। চীন শূন্য কোভিড নীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের চাহিদা বাড়ছে। ফলে এ সময় দাম বাড়লে তেল উৎপাদনকারীদের মুনাফা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে।

এদিকে ওপেকের তেল উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। কারণ, তেলের দাম কমিয়ে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে মার্কিনিরা সৌদি আরবসহ তাদের অন্য মিত্রদের উৎপাদন বাড়িয়ে তেলের দাম কমানোর আহ্বান জানিয়েছিল। অথচ তারা যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে উল্টো উৎপাদন কমাল।

এমনকি গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরব সফর করেছিলেন মূলত এ লক্ষ্যেই, অর্থাৎ সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির অনুরোধ করতে। কিন্তু তখনো সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বাইডেনের কথায় কর্ণপাত করেননি।

ক্লিয়ারভিউ এনার্জি পার্টনারস এলএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেভিন বুক বলেছেন, ওপেক উৎপাদন কমিয়েছে, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রলের দাম প্রতি গ্যালনে প্রায় ২৬ সেন্ট বাড়তে পারে।

তেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো গ্রীষ্মকালে গ্যাসোলিনের মিশ্রণ পরিবর্তন করে। এতে গ্রীষ্মকালে গ্যাসের দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। মার্কিন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালে প্রতি গ্যালন তেলের দাম গড়ে ৩২ সেন্ট বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ভূরাজনীতিতে মার খাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়বে ওপেকের এ সিদ্ধান্তের কারণে।

ওপেকের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে রাশিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেই বলেই দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ভূরাজনীতির নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল উৎপাদন কমেছে

বাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ফিনাল্টোর বিশ্লেষক নেইল উইলসন ইকোনমিক টাইমসকে বলেছেন, সৌদি আরব এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় পায় না। তারা জানে, ওপেকের সমর্থন তার পক্ষেই আছে।

নেইল উইলসন আরও বলেন, যা করা দরকার, সৌদি আরব ঠিক তা-ই করছে এবং সে ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজের বলার কিছু নেই।

ওপেক প্লাস মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল এখন আর তার জন্য হুমকি নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল উৎপাদন কমে গেছে। এতে ওপেক তেল উৎপাদন হ্রাস করলেও সদস্যদেশগুলোর বাজার হিস্যা কমবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে তার স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ। বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে তারা সময়-সময় এ মজুত থেকে তেল বাজারে ছাড়ে। কিন্তু গত এক বছরে তারা এ মজুত থেকে তেমন একটা তেল বাজারে ছাড়েনি। ভবিষ্যতেও ছাড়বে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সে কারণেই ওপেকের এত আত্মবিশ্বাস।