ইসরায়েল অভিমুখে জাহাজ চলাচল বন্ধ করেছে চীনা কোম্পানি

চীনা জাহাজ কোম্পানি কসকো ইসরায়েল অভিমুখে জাহাজ চলাচল বন্ধ করেছে। আজ রোববার ইসরায়েলি বাণিজ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবসকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর দিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে ওই প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি।

লোহিত সাগর পথে চলা জাহাজের ওপর ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার প্রেক্ষাপটে চীনা কোম্পানিটির এই সিদ্ধান্ত এল। ইরান-সমর্থিত হুতি গোষ্ঠী কয়েক সপ্তাহ ধরে লোহিত সাগরে চলাচলকারী বেশ কিছু জাহাজের ওপর হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলে অবস্থিত কসকো কোম্পানির কর্মকর্তারা জাহাজ চলাচল বন্ধের খবরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইসরায়েলি বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন যে তাঁরা এই খবর খতিয়ে দেখছেন।

এর আগে দুই বড় জাহাজ কোম্পানি ডেনমার্কের মায়ার্সক ও জার্মানির হাপাগ-লয়েড লোহিত সাগর দিয়ে পুনরায় জাহাজ চালানোর ঘোষণা দিয়ে গত সপ্তাহে পিছিয়ে আসে। লোহিত সাগরপথে জাহাজ চলাচল শুরু করার পর আবার তাদের একটি জাহাজে হামলা হওয়ায় গত মঙ্গলবার জাহাজ চলাচল স্থগিত করার ঘোষণা দেয় মায়ার্সক।

লোহিত সাগরের পথ বাদ দিয়ে মায়ার্সক ও হাপাগ-লয়েড আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে জাহাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এতে পণ্য পরিবহনের খরচ থেকে শুরু করে জাহাজ চলাচলের সময় সবই বেড়ে যাবে। ফলে এর প্রভাব পড়বে পণ্যের মূল্যে।

গত ১৫ ডিসেম্বরের পর বিশ্বের পাঁচটি বড় কনটেইনারবাহী জাহাজের মধ্যে চারটিই লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করার কথা ঘোষণা করে। সুয়েজ খাল থেকে যে জাহাজগুলো আসে, সেগুলোকে লোহিত সাগর হয়ে চলতে হয়। ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হুতিরা আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যপথে জাহাজের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

দৃশ্যত গাজার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে হুতি বিদ্রোহীরা এই আক্রমণ চালাচ্ছে, সম্প্রতি যা অনেকটাই বেড়েছে। তবে এই নৌ সংকট সৃষ্টি হয়েছে গাজা ভূখণ্ড থেকে হাজার মাইল দূরে। আর এ সংকটের জেরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নতুন মোড় নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

লোহিত সাগরে কেন এই সমস্যা  
আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকার মধ্যে অবস্থিত লোহিত সাগর। এর একেবারে উত্তর দিকে সুয়েজ খাল, আর দক্ষিণে বাব আল-মান্দাব প্রণালি, যা লোহিত সাগরকে গালফ অব এডেনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। বাব আল-মান্দাব আরবি শব্দ, যার অর্থ অশ্রুর দুয়ার। এটি ইয়েমেনকে আফ্রিকার দুই দেশ জিবুতি ও ইরিত্রিয়া থেকে পৃথক করেছে।

প্রায় ২০ মাইল বা ৩২ কিলোমিটার চওড়া এই প্রণালিতে জাহাজ চালানো খুবই কঠিন। আরব দেশের রূপকথায় আছে, এক মারাত্মক ভূমিকম্পের ফলে এই প্রণালি তৈরি হয়ে আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকা পৃথক হয়ে পড়েছিল, আর এখানে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল অসংখ্য মানুষের। সে কারণেই এটি অশ্রুর দুয়ার।

ভারত মহাসাগর থেকে ইউরোপে যেতে হলে সবচেয়ে সহজ ও কম খরচের পথ লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়া। সুয়েজ খাল হয়ে জাহাজ অল্প সময়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পণ্য ইউরোপে পাঠাতে অথবা ইউরোপ থেকে পণ্য এসব গন্তব্যে পাঠাতে এটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা পথ।

সত্যিকার অর্থে লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। প্রতিবছর অন্তত ১৭ হাজার জাহাজ এবং বিশ্ববাণিজ্যের ১০ শতাংশ এই পথে পরিচালিত হয়। ইউরোপের জ্বালানির একটি বড় অংশই যায় লোহিত সাগরের মাধ্যমে। একইভাবে শস্য ও পাম অয়েলের মতো খাদ্যপণ্য এবং বিপুল পরিমাণ শিল্পপণ্য জাহাজে করে এই পথে পরিবহন করা হয়।

সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর পরিহার করে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে কোনো জাহাজ যদি এশিয়া থেকে ইউরোপ যায় অথবা ইউরোপ থেকে এশিয়ায় আসে, তাহলে দুই সপ্তাহ অতিরিক্ত সময় লাগে। সে কারণে জনবল, জ্বালানি ও বিমার জন্য অতিরিক্ত খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে।

যা করা হচ্ছে  
হুতিদের হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র লোহিত সাগর অঞ্চলে একটি সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করেছে। এই বাহিনীকে অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একটি বড় এলাকাজুড়ে এটি টহল দিচ্ছে। আগে বলা হয়েছিল, হুতিদের হামলা থেকে রক্ষা করা হবে এবং লোহিত সাগর অঞ্চল জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ, বাহিনীর পক্ষ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি বাণিজ্যিক জাহাজ কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হবে।

হুতিদের পক্ষে লোহিত সাগর পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না বলেই মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। এই গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধজাহাজ নেই, যার মাধ্যমে তারা সাগর ঘিরে ফেলতে পারে। এখন পর্যন্ত তারা মূলত গুলি ছুড়ে হামলা করেছে। একটি অভিযানে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে মার্কিন, ফরাসি ও তাদের মিত্রদের যুদ্ধজাহাজ ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে।