খেলাপি হওয়াই কি পাকিস্তানের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক হবে

পাকিস্তানের পতাকা

আর্থিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছে না। দেশটির সরকার নানাভাবে চেষ্টা করলেও এখনো প্রতিশ্রুতি মেলেনি। এমন অবস্থায় শ্রীলঙ্কার উদাহরণ উঠে আসছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ডনে ফাতিমা আতরওয়ালা বিশ্লেষণ করেছেন, খেলাপি হলে দেশটির জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা হবে কি না।

পাকিস্তান সরকার নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এখনো তাদের দেওয়া ঋণের কিস্তির ১২০ কোটি ডলার ছাড় করেনি। এ অর্থ পাকিস্তানের খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার কোনো ঝুঁকিতে নেই। তবে ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার আশঙ্কা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদি প্রতিশ্রুত অর্থ পাকিস্তান না পায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে?

‘শ্রীলঙ্কা কি ঋণ পরিশোধে খেলাপি হওয়ার পর ভালো আছে?’—এ নিয়ে পাকিস্তানে কেউ কথা বলতে চান না। তবে জোরেশোরে এ প্রশ্ন আরও একবার তুলেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডের (এফবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান শাব্বার জাইদি।

ডনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাব্বার জাইদির বক্তব্য ধারণা দিচ্ছে যে তিনি এমনটাই মনে করেন। ঠিক একই রকম ধারণা পোষণ করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি।

শাব্বার জাইদি বলেন, সব ধরনের সূচকেই শ্রীলঙ্কা ভালো করছে। তাদের উৎপাদন বাড়ছে, তাদের ভোক্তা অভ্যাস আগের চেয়ে ভালো, তাদের বিনিময়মূল্য স্থিতিশীল হয়েছে এবং তাদের রাজনীতি কম অস্থির। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা তাদের সমস্যাগুলো বুঝতে এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে।

তথ্যটি বিতর্কিত মনে হতে পারে, তবে শ্রীলঙ্কার রুপির বিনিময় হার কম অস্থির বলেই মনে হচ্ছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে খেলাপি হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার রুপি স্থিতিশীল হয়েছে। ওই সময়ে প্রতি ডলার ছিল ৩২৫ রুপি, গত সপ্তাহে ছিল ৩৪২ রুপি। অবমূল্যায়নের হার ৬ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানের রুপির অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৫৪ শতাংশ।

তবে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারের মত, শ্রীলঙ্কাও আইএমএফের একটি শর্ত পালন করছে। আর সেটা হচ্ছে অবাধ বিনিময় হারের ব্যবস্থা চালু করা, যা হবে বাজারভিত্তিক। শ্রীলঙ্কা ৭ মার্চ থেকে এমন এক ব্যবস্থা চালু করেছে, যার ফলে তাদের মুদ্রার মান পড়ছে।

ব্লুমবার্গের হিসাবে, শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি পাঁচ মাস ধরে কমছে। গত বছর মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশে পৌঁছার পর গত মাসে তা ৫০ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার এখনো এত উঁচুতে না উঠলেও দেশটির ভোক্তা মূল্যসূচক বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের স্বল্পমেয়াদি মূল্যস্ফীতি, যা সেনসিটিভ প্রাইস ইনডেক্সের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে এটি ১৬ মার্চে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ হয়েছে।

ফেডারেল রেভিনিউ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যন শাব্বার জাইদি বলেন, ‘বেশির ভাগ পাকিস্তানি যা মনে করেন, তার সঙ্গে আমার শ্রীলঙ্কাসংক্রান্ত বিশ্লেষণ মিলবে না। শ্রীলঙ্কা খুব বাজে একটা সময় কাটিয়েছে। যেকোনো দেশের জন্য খেলাপি হওয়াটা বেদনার বিষয়। তবে আমার প্রশ্ন হলো, মূল পার্থক্যটা আসলে কী? তারা তেল আমদানি করতে কিংবা ঋণপত্র খুলতে পারেনি। আর পাকিস্তানও ঠিক একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।’

তবে নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, শ্রীলঙ্কার এখনকার শান্ত অবস্থার মানে এই নয় যে দেশটি বর্তমানে ভালো আছে। তেলের জন্য হয়তো দীর্ঘ লাইন নেই। কিন্তু প্রতি পাঁচ পরিবারের দুটিই তাদের আয়ের ৭৫ শতাংশ খরচ করে শুধু খাদ্যসামগ্রী কিনতে। দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব বলেছে, অর্ধেক পরিবার শিশুদের কম খাদ্য দিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কাকে আইএমএফের কঠোর শর্ত পালন করতে হচ্ছে। সম্প্রতি তারা নীতি সুদহার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। এর সবই করা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য। তবে শ্রীলঙ্কার জন্য পরিস্থিতি আর খারাপ না হলেও পাকিস্তানের জন্য যে খারাপ হবে না, তা বলা যাচ্ছে না।

মুডি’স সম্প্রতি পাকিস্তানের রেটিং কমিয়ে সিএএএ৩ করেছে। সংস্থাটির রেটিংয়ের হিসাবে, এর নিচে রয়েছে সিএ (অর্থাৎ খেলাপি হওয়ার কাছাকাছি) এবং সি (অর্থাৎ খেলাপি)। শ্রীলঙ্কার অবস্থার সিএ-এর একধাপ নিচে।

শাব্বার জাইদি বলেন, ‘আমি বলছি না যে পাকিস্তান খেলাপি হোক। দেউলিয়া হওয়ার ভয় আসলে অজানা সম্পর্কে ভয়। তামিল টাইগার ইস্যুর কারণে শ্রীলঙ্কায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু খেলাপি হওয়ার কারণে সেখানে কোনো মানুষ মারা যায়নি। ঋণ খেলাপ একটি ট্যাবু বিষয়, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।’

শাব্বার জাইদি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু প্রায়োগিক অর্থে, আমরা খেলাপির পর্যায়ে পৌঁছে গেছি।’

শাব্বার জাইদি উদাহরণ হিসেবে আরেকটি দেশের কথা উল্লেখ করেন। দেশটি আর্জেন্টিনা। ‘অনেক দেশ, যেমন আর্জেন্টিনা, খেলাপি হয়েছে। কিন্তু তাদের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন তারা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে,’ তিনি বলেন।

আইএমএফ তাদের বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় প্রথম আর্জেন্টিনাকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। তবে আর্জেন্টিনা একটি নিয়মিত খেলাপি দেশ। তাদের ইতিহাসে তারা ৯ বার খেলাপি হয়েছে। এর মধ্যে তিনবার খেলাপি হয়েছে গত দুই দশেকর মধ্যে।

২০০১ সালে দেশটির সরকার ১৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বিশাল এক ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। শেষবার আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয় ২০২০ সালের মে মাসে।

উদাহরণ হিসেবে অনুকরণ করার মতো নয়, তবে মনে রাখা যেতে পারে।

র্জেন্টিনার নীতি সুদহার ৭৮ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশের বেশি। দেশটির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অস্থির—২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পরের বছরে তা ১০ দশমিক ৪ শতাংশে লাফ দেয়। ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ শতাংশ। আর্জেন্টিনার মুডি’স রেটিং সিএ।

২০২২ সালে আর্জেন্টিনা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়। আবার একই সঙ্গে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর এ ক্ষেত্রেও শাব্বার জাইদি সঠিক। খেলাপি হওয়ার পর তাদের বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতিশীল হয়েছে। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি ডলার, পরের বছর যা বেড়ে হয় ৬৬০ কোটি ডলার।

ইসলামাবাদে জার্মান রাষ্ট্রদূত আলফ্রেড গ্রানাস একবার বলেছিলেন, পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেশটির ‘আকর্ষণীয়’ সব প্রতিবেশী রয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক সংযোগ আর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বন্ধুরা সব সময়েই চাইবে পাকিস্তান যেন খেলাপি না হয় এবং সে কারণে তারা প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দেবে।

পাকিস্তান অবশ্য কখনোই বলেনি যে তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। বরং তারা কোনোভাবে টিকে থাকতে নতুন ঋণ নিচ্ছে কিংবা পুরোনো ঋণ নবায়ন করছে।

পাকিস্তান যদি খেলাপি হয়, তাহলে এখন যা ঘটছে—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থির বিনিময় হার এবং খাদ্যসংকট—তার সব কটির পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ এমন ধারণা দেয় যে পাকিস্তান অনাহার ও জড়তায় আরও ডুবে যাবে। আর অর্থ ধার করে তারা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করবে।