চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক, বন্ধু না হয়েও বাণিজ্যে ঐক্য

গ্রাফিক্স: প্রথম আলো

ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে দুই পক্ষকে যে বন্ধু হতে হয় না, তার উৎকৃষ্ট নজির অস্ট্রেলিয়া ও চীন। দুটি দেশের সম্পর্ক গত কয়েক বছরে খারাপ হলেও তাদের বাণিজ্য থেমে নেই; বরং ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। ২০২০ সালে তাদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, তখন অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেক রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য ছিল চীন। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মোট রপ্তানির মাত্র ৯ ও ৫ শতাংশে নেমে গেছে চীনের বাজারে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চীন সফরে গেছেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করাই যে তার লক্ষ্য, তা বলাই বাহুল্য। খবর বিবিসির।

২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া কোভিড-১৯ মহামারির উৎস সম্পর্কে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ঘোষণা দিলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে। সেই ঘোষণার পর চীন সরকার জানায়, অস্ট্রেলিয়াকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। তারই অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের সমমূল্যের পণ্যে শুল্ক ও নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে চীন। এর মধ্য দিয়ে চীন সরকার বুঝিয়ে দেয়, তারা অস্ট্রেলিয়ার এই তদন্তের বিষয় ভালোভাবে নেয়নি।

সেই টান টান পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার সরকার পরিবর্তন হলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে সব সময় ভালো ফল পাওয়া যায় এবং তাঁর মনে হয়, দেশ দুটি গঠনমূলকভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপ করতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের অ্যালবানিজ মনে করিয়ে দেন, চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাদের যে মোট বাণিজ্য, এক চীনের সঙ্গেই তার চেয়ে বেশি বাণিজ্য করে। বস্তুত দুই দেশের অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক, তাই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে চীনকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এটা বুঝতে পেরেছেন বলে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়েছেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সামরিক সম্পর্কেরও উন্নতি হচ্ছে।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতা

অস্ট্রেলিয়ার মূল সম্পদ হচ্ছে তার খনিজ সম্পদ। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ আছে দেশটিতে। ঠিক সে কারণে চীনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে চীনের অবকাঠামো খাতে প্রতিবছরই বিপুল বিনিয়োগ হয় আর সেই অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বড় জোগান আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়া থেকে চীন বিপুল পরিমাণে লৌহ আকরিক ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই দুই পণ্যে চীন কখনো বিধিনিষেধ বা শুল্ক আরোপ করেনি।

চীনের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩০ শতাংশ আসে আবাসন খাত থেকে। সম্প্রতি তাদের আবাসন খাতের দুরবস্থার কারণে অস্ট্রেলিয়ার ইস্পাত খাত ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।

লৌহ আকরিক ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে ওয়াইন ও গলদা চিংড়ি আমদানি করে চীন। চীনের নাগরিকেরা এই ওয়াইন বা গলদা চিংড়ি না খেলে তেমন কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু চীনের কারখানা ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় ইস্পাত অস্ট্রেলিয়া থেকে না এলে বিপদ। এত পরিমাণ লোহা অন্য দেশ থেকে আনা কঠিন।

চীন বুঝতে পেরেছে, অস্ট্রেলিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে লাভ নেই—দেশটিকে চাপাচাপি করা হলে তারা উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঘেঁষে যাবে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বেইজিং যে অস্ট্রেলিয়ার পণ্য থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে বা সেখান থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বা দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে, সেটা মূলত অস্ট্রেলিয়াকে ওয়াশিংটন থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে।

আরেকটি কারণ হলো, অস্ট্রেলিয়াকে প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা সিপিটিপিপিতে নিয়ে আসা। এই বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে চীন বিশ্বের বৃহত্তম মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থান ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বিক্রিতে নিজেরা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি বন্ধুদেশগুলোকে চাপ দিচ্ছে, যেন তারাও চীনের কাছে প্রযুক্তি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। চীনের কাছে খনিজ বিক্রিতেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এসব কারণে অস্ট্রেলিয়া চীনের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর অর্ধেক লিথিয়াম পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে লিথিয়ামের এখন ব্যাপক চাহিদা। ফলে লিথিয়াম না পেলে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে রাজত্ব করার উচ্চাভিলাষ মার খাবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য যতই বাড়ুক না কেন, ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার খেলায় যখন চূড়ান্ত অবস্থান নেওয়ার সময় আসবে, তখন অস্ট্রেলিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই বিশ্লেষকদের।

  • বিবিসির প্রতিবেদন অবলম্বনে