মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে, তবু কেন বাড়ছে না তেলের দাম

জ্বালানি তেল
ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র লড়াই চলছে। বিশ্বের বেশির ভাগ পেট্রোলিয়াম সম্পদ এই অঞ্চল থেকেই আসে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এবার যুদ্ধের কারণে তেলের দাম প্রাথমিকভাবে বাড়লে পরবর্তী সময়ে তা কমতে শুরু করে।

নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত ব্রেন্ট ক্রুডের দাম এখন ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তেলের যে দাম ছিল, এখন দাম তার চেয়ে কম। অর্থাৎ একটি যুদ্ধ চললেও বাড়ছে না তেলের দাম। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুদ্ধ যতই তীব্র হোক না কেন, তেলের সরবরাহে বিশেষ ঘাটতি হয়নি। সে জন্য ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, আপাতত যুদ্ধের কারণে তেমন কোনো হুমকি নেই।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এনার্জি অ্যাসপেক্টসের ভূরাজনীতি বিভাগের প্রধান রিচার্ড ব্রোঞ্জ বলেছেন, ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন, ঝুঁকি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা সতর্ক থেকে বেশি তেল কিনছেন না।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, ব্যবসায়ীরা একভাবে ধরেই নিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সবকিছু ভুল পথে যাবে না। তাঁরা বলছেন, বাজারে কার্যত সরবরাহ-ঘাটতি তৈরি না হলে তেলের দাম বাড়বে না।

তেলের বাজার থেকে যুদ্ধ কার্যত উধাও হয়ে গেছে; বরং বাজার একধরনের নিরাশার মধ্যে ঢুকেছে। চীনের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে পেট্রোলিয়ামের চাহিদা নিয়ে একধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে; সেই সঙ্গে অন্য বড় তেল আমদানিকারী দেশগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

তা করতে গিয়ে সৌদি আরব উল্টো বিপদে পড়েছে। তেল থেকে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় দেশটির জিডিপি এবার সংকুচিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তেলের দাম যেকোনোভাবে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের ওপরে রাখতে চায় তারা।

বাজার-বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৪ সাল তেলের বাজারের জন্য খুব কঠিন সময় হতে যাচ্ছে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পূর্বাভাস, আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের চাহিদা কমে যেতে পারে, বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়িসহ আরও উন্নত মানের ইঞ্জিনবিশিষ্ট গাড়ি ও মানুষের যাতায়াতের চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে এনার্জি ইনফরমেশন।

ইসরায়েল-হামাস সংকটের আগে বাজারের মন্দাবস্থার কারণে দাম কমে গিয়েছিল। সেই মন্দাবস্থা এখনো বাজারে প্রভাব ফেলছে, যদিও যুদ্ধ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বাজারে একধরনের স্বস্তির ভাব আছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক তেল উৎপাদন রেকর্ড ১৩ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেলে উঠেছে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমডিটি ইনসাইটসের গবেষণা বিভাগের প্রধান জিম বারখার্ড বলেছেন, মূলত এসব কারণে, অর্থাৎ বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকায় তেলের দামে প্রভাব পড়ছে না।

তবে বাজারে তেলের সরবরাহ যেকোনো সময় ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চার বছর আগে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে তাদের তেল সরবরাহ অর্ধেক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এখনো পরিস্থিতি চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেটা হলে বাজারে তেলের বিপুল ঘাটতি সৃষ্টি হবে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাবে।

ইসরায়েল-হামাস সংকটের প্রভাব তেলের বাজারে যে প্রভাব পড়ছে না, সে কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একধরনের সন্তুষ্টির ভাব আছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংকট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক হেলিমা ক্রফট নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম কয়েক দিনে বেশ কিছু সফলতা অর্জিত হয়েছিল; কিন্তু শেষমেশ সেই যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাঁর আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রীতিকর চমকের সম্মুখীন হতে পারে।

পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বাইডেন প্রশাসন সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছে। ইরানও চায়, পারস্য উপসাগর দিয়ে যেন তেলবাহী ট্যাংকারের চালান অব্যাহত থাকে। তেল পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে তাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, আবার দাম বেড়ে গেলে তাদের গ্রাহকেরা বিমুখ হতে পারে।

এনার্জি অ্যাসপেক্টসের রিচার্ড ব্রোঞ্জ বলেছেন, এই সংঘাত সীমার মধ্যে থাকবে এবং বড় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোয় তা ছড়িয়ে পড়বে না তেমন সম্ভাবনা আছে। তবে ভুল বিচার ও হিসাব অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণ হতে পারে।