যে কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে চায় চীন

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনরয়টার্স

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গত বছর দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হেইলংজিয়াং প্রদেশ সফরে যান। এটি চীনের রাস্টবেল্ট (যেখানকার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে) অঞ্চলের একটি। চীনের অর্থনীতিতে এখন কী ধরনের সমস্যা জেঁকে বসেছে, এই অঞ্চল তার একটি নজির।

হেইলংজিয়াং অঞ্চলের জন্মহার চীনের মধ্যে সবচেয়ে কম; এখানকার বড় বড় শহরে বাড়ির দাম কমছে। ২০২৩ সালে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়ের পর দেখা যায়, এই অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি একেবারে হয়নি বললেই চলে; উল্টো গভীর মূল্যহ্রাসের কবলে পড়েছে এই অঞ্চল।

দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ সি চিন পিংয়ের পরিকল্পনা আছে। গত বছর সেই সফরে গিয়ে সি চিন পিং প্রাদেশিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান, তাঁরা যেন ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তির’ বিকাশ ঘটান। এরপর এই শব্দবন্ধ বেশ কয়েকবার সংবাদপত্র ও সরকারি অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হয়েছে। গত মাসে দেশটির রাবার স্ট্যাম্প সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াং জিয়াংকিং এই শব্দবন্ধকে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন; অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে যে নব চীনের সূচনা হয়, সেই সময় যে নীতির ভিত্তিতে তা হয়েছিল, তার সঙ্গে এই ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তি’ শীর্ষক স্লোগানের তুলনা করেছেন তিনি। সংস্কার ও বাজার উন্মুক্ত করার স্লোগান চীনের জাতীয় জীবনে এখনো জ্বলজ্বলে—নতুন এই স্লোগানও দীর্ঘদিন থেকে যাবে বলে ধারণা।

এই শব্দের অর্থ কী? চীনের সরকারি কর্মকর্তারা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে হন্যে হয়ে যাচ্ছেন। বহু বছর ধরে চীনের উৎপাদক শক্তি ছিল মূলত শ্রমিক ও পুঁজি সংগ্রহনির্ভর। ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চীনের শ্রমশক্তি আকার বেড়েছে ১০ কোটি; অর্থাৎ এই সময়ে আরও ১০ কোটি মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছেন। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এশিয়া প্রোডাকটিভিটি অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে, ২০০১ সালের পরবর্তী দুই দশকে; অর্থাৎ ২০ বছরে চীনের পুঁজির পরিমাণ জিডিপির ২৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর এই পুঁজি সংগ্রহ হয়েছে মূলত নতুন নতুন সম্পদ ও অবকাঠামো খাতে।

চীনের কর্মশক্তি যেমন কমছে, তেমনি সে দেশে সম্পত্তির চাহিদাও কমছে। আগে যত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে যেতেন, এখন তত মানুষ যাচ্ছেন না। আবাসন খাত থেকে যে ফাটকাবাজি করে মুনাফা করা যাবে, তার নিশ্চয়তা এখন আর নেই এবং সম্ভাব্য বাড়ি ক্রেতারাও এখন আগেভাগে ফ্ল্যাট কিনতে অনাগ্রহী। কারণ, তাঁদের মনে ভয়, বিপর্যস্ত আবাসন কোম্পানিগুলো ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করার আগে নিঃস্ব হয়ে যায় কি না।

আবাসন খাতের সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস যেমন কমেছে, তেমনি জমি বিক্রি করে স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। কোভিডজনিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও চীনের অর্থনীতিতে গতি আসছে না। পুনরুদ্ধার যা হচ্ছে, তা সব খাতে সমানভাবে হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় এত বেশি নয় যে সব কর্মক্ষম মানুষের কাজ সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে টানা তিন ত্রৈমাসিকে চীনের মূল্যহ্রাস হচ্ছে, যেখানে অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে।

নতুন প্রযুক্তির পরিচর্যা

চীন এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ সাধারণত সেবা খাতমুখী হয়; অর্থাৎ উৎপাদন খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সেবা খাত নির্ভর হয়। কিন্তু চীন সরকারের হৃদয় যেন অন্য কোনো খানে লুকিয়ে আছে। মহামারির কারণে চীনের উৎপাদিত পণ্য, যেমন সার্জিক্যাল মাস্ক থেকে শুরু করে এক্সারসাইজ বাইকের চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দেশের ভেতরেও লিথোগ্রাফি মেশিন থেকে শুরু করে বিমানে ব্যবহারের উপযোগী স্টেইনলেস স্টিল উৎপাদনের চাহিদা নতুন করে বেড়েছে।

দেশটির ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে উৎপাদন খাতের হিস্যা ধরে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে; ২০০৬ সালে যা ছিল জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ, ২০২০ সালে যা এক-চতুর্থাংশের কিছুটা ওপরে।

চীন অনেক দিন ধরেই উৎপাদন খাতে পরিশীলন আনার চেষ্টা করছে, সে জন্য তারা যথাযথ নীতি প্রণয়নেরও চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি তারা সেমিকন্ডাক্টর প্রকৌশলে নতুন একাডেমিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিল্পনীতিতে দেশটি যত ব্যয় করে, যেমন ভর্তুকি ও করছাড়, তা যুক্তরাষ্ট্রও করে না। নতুন প্রযুক্তির পরিচর্যা ও পুরোনো শিল্প খাতের আধুনিকায়ন করে চীন পরবর্তী শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে চায়; অর্থাৎ সেবা খাত নির্ভর না হয়ে চীন এখনো উৎপাদন খাতের ওপর ভর করে এগোতে চাইছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তি’ স্লোগান দিয়ে চীন মার্ক্সবাদী ও নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতির তত্ত্বের মিশেল ঘটিয়েছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে চীন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাইছে—প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মনে করেন, উৎপাদন খাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নতুন এই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটবে। এই কথার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, প্রযুক্তি খাতে চীনের উচ্চাভিলাষ আগের চেয়ে বেড়েছে এবং অর্থনীতির সঙ্গে তা আরও ভালোভাবে সমন্বিত হচ্ছে। চীনের নেতারা প্রযুক্তি খাতে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে পুরো জাতিকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই গত মার্চ মাসে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার যে বাজেট দিয়েছে, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাতে বরাদ্দ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। অন্য কোনো খাতে বরাদ্দ এতটা বাড়েনি।

শিল্প খাতের আধুনিকায়ন ও নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ—এই দুই মন্ত্রে ভর করে এগোতে চায় চীন; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হতে চায় এই কৌশলে। তৃতীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, মূল্যহ্রাসের প্রবণতা ঘুরিয়ে দিতে এটি জরুরি। দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে প্রথমে অর্থনীতিকে আবারও মূল্যস্ফীতির ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।