আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে জ্বালানি তেল। সব কাজেই এই জ্বালানির ব্যবহার হয়। গাড়ি চালনা থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা—সবকিছুতেই জ্বালানি তেল প্রায় অপরিহার্য। যেসব দেশের হাতে তেলের ভান্ডার আছে, তারা অনেকেই ফুলেফেঁপে উঠেছে। ফলে তেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলো সব সময়ই তৎপর।
কোনো অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে, না খারাপ অবস্থায়, তা বোঝার একটি মানদণ্ড হচ্ছে জ্বালানি তেলের ব্যবহার। অর্থনীতি ভালো থাকলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়ে যায় আর খারাপ থাকলে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যায়। কয়েক বছর ধরে যে এত ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী, তার মূল কারণ অর্থনীতির ধীরগতি। বিশেষ করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের ধীরগতি।
তা সত্ত্বেও বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর মধ্যে তেল কোম্পানিগুলো সামনের সারিতে। দেখে নেওয়া যাক, বিশ্বের বৃহত্তম তেল কোম্পানি কোনগুলো—
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি সৌদি আরামকো বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও রাসায়নিক কোম্পানি। একই সঙ্গে বাজার মূলধনের দিক থেকে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম কোম্পানি। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রধান কার্যালয় সৌদি আরবের দাহরানে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে ১০০টি তেল ও গ্যাসক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে এই কোম্পানি। আরামকোর তেলের রিজার্ভ ২৭০ বিলিয়ন ব্যারেল। তাদের দৈনিক উৎপাদনসক্ষমতা ১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২৭ লাখ ব্যারেল। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি ৬০৫ বিলিয়ন বা ৬০ হাজার ৫০০ কোটি ডলার আয় করেছে। এই সময় তারা মুনাফা করেছে ১৬১ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
তেল ব্যবসায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই কোম্পানি বহুল পরিচিত। এক্সন ও মবিল করপোরেশন একীভূত হয়ে ১৯৯৯ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। তেল উত্তোলন থেকে পরিশোধন—অনেক কিছুই করে থাকে এই কোম্পানি। বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের ৩ শতাংশ এবং জ্বালানির ২ শতাংশ সরবরাহ করে এই কোম্পানি। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এই কোম্পানি দৈনিক ৪৮ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করেছে। জ্বালানি কোম্পানি হিসেবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসেও ভূমিকা পালন করছে এই কোম্পানি। ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে তারা ১৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
বাজার মূলধনের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম এই তেল কোম্পানি সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ কোম্পানি। ১৮৭৯ সালের প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনে। তেল অনুসন্ধান, উৎপাদন, পরিশোধন—সব ক্ষেত্রেই শেভরনের বিনিয়োগ আছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের ১৮০টি দেশে নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী প্রযুক্তিতেও বিনিয়োগ করেছে তারা। তাদের কর্মিসংখ্যা ৪৫ হাজার। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শেভরনের দৈনিক উৎপাদনসক্ষমতা ছিল ৪ দশমিক ০৯ মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ৯ হাজার ব্যারেল।
বিশ্বের শীর্ষ তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪ নম্বরে আছে চীনের এই কোম্পানি। বাজার মূলধনের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে এটি বিশ্বের ৫৯তম শীর্ষ কোম্পানি। এটি চীনের বৃহত্তম তেল কোম্পানি। চীনসহ বিভিন্ন দেশে তাদের ১৮ হাজার ফিলিং স্টেশন আছে। ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি। এটি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রধান কার্যালয় চীনের রাজধানী বেইজিং। তেল উত্তোলন, পরিশোধন, পেট্রোকেমিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে তাদের কার্যক্রম। এ ছাড়া অপ্রচলিত গ্যাস, শেল অয়েল ও বিভিন্ন বিদেশি উদ্যোগে তাদের বিনিয়োগ আছে।
জ্বালানি তেল খাতে বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম এই কোম্পানি আর সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ৮২তম বৃহৎ কোম্পানি। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাসায়নিক তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি। বিশ্বের ১৪০টি দেশে এই কোম্পানি সক্রিয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম আছে—মোট কর্মিসংখ্যা ৮৩ হাজার। চলতি বছর এই কোম্পানির বাজার মূলধন বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যেখানে গত বছর তাদের বাজার মূলধন কমেছিল ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ব্রিটিশ ও ডাচ বহুজাতিক এই কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, এলএনজি পরিশোধন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশ্বের ৭০টির বেশি বিনিয়োগ করেছে।
বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম এই তেল কোম্পানি এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ১৪০তম কোম্পানি। ২০২৫ সালে এই কোম্পানি বাজার মূলধন বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যদিও ২০২৪ সালে তা কমেছিল ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রথম নাম ছিল টোটাল। তেল-গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন, রাসায়নিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে এই কোম্পানির ব্যবসা আছে। বিশ্বের ১৩০টি দেশে এই কোম্পানির কার্যক্রম বিস্তৃত। তাদের দৈনিক উৎপাদনসক্ষমতা ২৮ লাখ ব্যারেল।
বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম কোম্পানি সিনুক, যা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ১৫৪তম বৃহৎ কোম্পানি। এটি চীনের বৃহত্তম অফশোর তেল ও গ্যাস কোম্পানি। ১৯৮২ সালের প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির বিশেষত্ব হলো অফশোর উৎপাদন। বোহাই উপসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের তেল খনি আছে। এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তাদের বিনিয়োগ আছে। তাদের কর্মিসংখ্যা ৯৮ হাজার।
বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম এই কোম্পানি। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ১৮০তম কোম্পানি। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম তেল কোম্পানি। বিশ্বের ১৫টি দেশে এই কোম্পানির কার্যক্রম বিস্তৃত। তারা স্বল্প খরচে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিখ্যাত। তাদের দৈনিক তেল উৎপাদনসক্ষমতা ১৫ লাখ থেকে ১৬ লাখ মিলিয়ন ব্যারেল। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে তারা কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের চেষ্টা করছে। এই কোম্পানি ২০১১ সালে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের কাজ পায়। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ চালালেও পরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়।
বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম এই তেল কোম্পানি। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ১৯৫তম কোম্পানি। চলতি বছর কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আবুধাবিভিত্তিক এই কোম্পানি বিশ্বের ১১টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বিশ্বের ১১টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এই কোম্পানি। আবুধাবি শহরের ৮৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ও পানি তারা সরবরাহ করে।
বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম এই তেল কোম্পানি এবং সামগ্রিকভাবে ২০১তম বৃহৎ কোম্পানি। কানাডার এই কোম্পানি কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল ও তরল গ্যাসের পাইপলাইন পরিচালনা করে। চলতি ২০২৫ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কোম্পানিটির সমন্বিত সম্পদ ছিল ১৫৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ১৫ হাজার ৫৮৩ কোটি ডলার।
তবে কার্বন নিঃসরণজনিত পরিবেশদূষণের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ এখন জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সৌরশক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ব্যবহার। এই বাস্তবতায় জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোর প্বৃরদ্ধির হার হয়তো কমে আসবে, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র: কোম্পানিসমার্কেটক্যাপডটকম।