তেলের ব্যবসায়ীরা এখন ভেনেজুয়েলায় ছুটছেন কেন

জ্বালানি তেল
রয়টার্স

ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসের অন্যতম দামি হোটেল হচ্ছে দ্য ককটেল বার। সেই হোটেল ইদানীং মানুষে গিজগিজ করছে। এক টেবিলে ইংরেজিভাষী একদল ব্যবসায়ী তুমুল উত্তেজনা নিয়ে তর্কবিতর্ক করছেন। লবির অপর দিকে একদল ভারতীয় ব্যবসায়ীকে দেখা গেল, যাঁরা কেবলই হোটেলে এসেছেন। ওয়েটারের ভাষ্য, সপ্তাহটা ভালোই যাচ্ছে; ‘তেল ব্যবসায়ীরা শহরে ফিরে এসেছেন’।

দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত তেলের মজুত ভেনেজুয়েলায়, তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা এত দিন সেই তেল ব্যবহার করতে পারেনি। কিন্তু গত মাসে হঠাৎই যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ব্যবসায়ীরা দেশটির রাজধানী কারাকাসের বিভিন্ন হোটেল ভিড় করতে শুরু করেন।

গত ১৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ ঘোষণা দেয়, বছরের পর বছর ধরে ভেনেজুয়েলার তেল, খনি ও ব্যাংকিং খাতে যত নিষেধাজ্ঞা ছিল, তার প্রায় সবই তাৎক্ষণিকভাবে তুলে নেওয়া হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট তার আগের দিন বার্বাডোসে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যে ঐকমত্যে এসেছিলেন, তার স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। আগামী বছরের নির্বাচন কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায়, ঐকমত্যে তার রূপরেখা প্রণীত হয়।

এভাবে একদাগে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সেটা হলো, একসময় তারা একটি একটি করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করত, একবারে নয়।

ভেনেজুয়েলায় কর্মরত এক পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘আমাদের সবার অগ্রাধিকার বদলে গেছে।’ ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক মতৈক্যের কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্র সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, বিষয়টি সে রকম নয়। বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল-হামাস লড়াইয়ের কারণে তেলের বিকল্প জোগানদাতা হিসেবে ভেনেজুয়েলার প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ভেনেজুয়েলার ৫০ হাজার নাগরিক মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উপস্থিত হন—উভয় কারণেই জো বাইডেন প্রশাসন এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণে মার্কিন নাগরিক, কোম্পানিসহ প্রায় সবাই এখন ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে; তবে তা পারবে না কেবল রুশ সরকার ও তার নাগরিকেরা, যাঁদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে। ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রেও কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

ভেনেজুয়েলা সরকারের বন্ডের সেকেন্ডারি ট্রেডিংয়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা–ও তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই এসব বন্ডের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় খনি কোম্পানি মিনেরভেন কালো তালিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোসহ আরও ১১০ জনের বেশি ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল।

ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ। এ খারাপ অবস্থার দায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ওপর চাপিয়েছে। তবে ইকোনমিস্ট মনে করে, এটা সত্যের বিকৃতি। ২০০০ সালের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে, যখন মাদুরোর পূর্বসূরি হুগো শ্যাভেজ ক্ষমতায় ছিলেন। তখন নিষেধাজ্ঞার আওতা ছিল খুবই ছোট। ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জামানায় বরং নিষেধাজ্ঞার জাল বিস্তৃত হয়।

ভেনেজুয়েলার ওপর সবচেয়ে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় ২০১৯ সালে। জালিয়াতির নির্বাচনে জয়লাভ করে মাদুরো দ্বিতীয়বারের মতো ছয় বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন—এমন অভিযোগে সেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তখন শত শত মানুষ ও কোম্পানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে। এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র তখন জাতীয় সংসদের নির্বাচিত নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে ভেনেজুয়েলার ন্যায়সংগত প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। নিকোলাস মাদুরোই ক্ষমতায় থেকে যান এবং গুয়াইদোর দাবি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি আস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ নানাবিধ। একটি হলো, ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে সরকারের স্বজনতোষী নীতির অংশীদার থাকার কারণে শেষমেশ মাদুরোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। আরেকটি কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র যত নিষেধাজ্ঞা দিক না কেন, তা পাশ কাটাতে ভেনেজুয়েলাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

২০১৯ সাল থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ভেনেজুয়েলার তেল বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছে দিচ্ছে। এই তেল মূলত চীনের ছোট ছোট স্বাধীন পরিশোধনাগারগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও সেটা সরাসরি নয়, বরং মালয়েশিয়া ঘুরে, নানা হাত বদল হয়ে তা চীনের বন্দরে পৌঁছায়। ঠিক ইরান যে কায়দায় তেল পরিবহন করে, অর্থাৎ নামগোত্রহীন জাহাজে করে বা জাহাজের ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রেখে তারা তেল পরিবহন করে, ভেনেজুয়েলার তেলও সেই পদ্ধতিতে পরিবহন হয়। ক্রেতাদের লাভ হলো, এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববাজারের প্রায় অর্ধেক দামে তেল পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমাতে অনেক চেষ্টাচরিত্র করছে। তার অংশ হিসেবে ভেনেজুয়েলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হচ্ছে, ভেনেজুয়েলার তেল বাজারে এলে যে সরবরাহ ও দামের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, তেমন সম্ভাবনা কম।

ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পিডিভিএসএর উৎপাদন খুবই কম। স্বল্প মেয়াদে এই রাষ্ট্রীয় কোম্পানির উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়, বিশেষ করে যখন এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রাথমিক মেয়াদ মাত্র ছয় মাস।

হুগো শ্যাভেজ ক্ষমতায় আসার আগে পিডিভিএসএ কোম্পানি যে পরিমাণ তেল উৎপাদন করত, এখন করে তার পাঁচ ভাগের একভাগ। অনেক দিন ধরে কোম্পানিতে বিনিয়োগ হয়নি এবং সেই সঙ্গে বাজে ব্যবস্থাপনার কারণে অবস্থাও সঙিন। অথচ ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এই কোম্পানি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উৎপাদনশীল তেল কোম্পানিগুলোর অন্যতম।

নিকোলাস মাদুরোর কাছে এসব কোনো বিষয় নয়। এক দশক ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে বলা যায়, তিনি অপ্রাকৃত সক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাঁর এখন প্রয়োজন হচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য সমর্থন ও নগদ অর্থ জোগাড় করা। অর্থনীতি নিষেধাজ্ঞামুক্ত হলে এবং দেশের মূল রপ্তানি পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ হলে অভীষ্ট অর্জন সহজ হয়ে যায়। সে জন্য তিনি বার্বাডোজ চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন।

মাদুরো একেবারে বিপদমুক্ত নন। দেশটির বিরোধী দলের প্রাথমিক নির্বাচনে মারিয়া করিনা মাচাডো নির্বাচিত হয়েছেন; কিন্তু তিনি সেই ২০১৫ সাল থেকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ। খেলা সেখানেই জমে উঠেছে। বাইডেন প্রশাসন নিকোলাস মাদুরোকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে, যার মধ্যে মাচাডোকে রাজনীতিতে পুনর্বহাল করতে হবে—এ শর্তের ভিত্তিতে ভেনেজুয়েলার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অথচ মাদুরো সরকার বিরোধী দলের এই প্রাথমিক নির্বাচনকে ‘জাল’ আখ্যা দিয়ে যারা তা করেছে, তাদের বিচার করার হুমকি দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যে শিগগিরই ভেনেজুয়েলার ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, তা হয়তো নয়। তাদের সতর্কবাণী, এ পরিস্থিতিতে কারাকাসের হোটেলগুলোতে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জড়ো হচ্ছেন, তাঁদের মনে রাখা দরকার, ভেনেজুয়েলায় যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি ঝুঁকিও আছে।