ক্রিপ্টোকারেন্সি: শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের সম্পদমূল্য কমেছে ১১ হাজার কোটি ডলার

২০২২ সাল ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য মোটেও ভালো ছিল না। গত বছর এর দাম এত পরিমাণে কমেছে যে এই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায় যাঁরা শতকোটি ডলারের মালিক, তাঁদের সম্পদমূল্য ১১০ বিলিয়ন ডলার বা ১১ হাজার কোটি ডলার কমেছে। খবর ফোর্বসের।

জালিয়াতির অভিযোগ, বিভিন্ন দেশে সরকারের মামলা, অন্তর্কোন্দল, সম্পদের মূল্যায়ন হ্রাস—এসব কারণে ২০২২ সাল বিনিয়োগকারীদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। গ্রেপ্তার হয়েছেন ক্রিপ্টোজগতের রাজাখ্যাত স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রায়েড। নজরদারিতে আছেন আরও অনেকে।

গত বছর ফোর্বস ম্যাগাজিন ১৯ জন ক্রিপ্টো বিলিয়নিয়ার বা শতকোটি ডলারের মালিককে চিহ্নিত করেছিল। তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৪০ বিলিয়ন ডলার বা ১৪ হাজার কোটি ডলার। অথচ চলতি বছরের ১০ মার্চ তাঁদের সম্পদমূল্য নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন এখন আর শতকোটি ডলারের মালিক-ই নন।

গত বছর ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির হোতার নাম স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রায়েড। স্যাম ছিলেন ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ এফটিএক্সের প্রতিষ্ঠাতা। এই এফটিএক্সের কাঁধে ভর করে রীতিমতো আকাশে উড়ছিলেন এই তরুণ।

গত বছরই ফোর্বসের ধনী তালিকায় ৫০তম স্থানে উঠে এসেছিলেন ৩০ বছরের স্যাম। তখন তাঁর সম্পত্তি ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। সেই স্যামেরই প্রতিষ্ঠান এফটিএক্স গত নভেম্বরে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। স্যামের বিরুদ্ধেও ওঠে জালিয়াতির অভিযোগ। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের অর্থ স্যাম নিজের ব্যক্তিগত সংস্থায় নিয়ে গেছেন। এরপরই তদন্ত এবং আমেরিকান কংগ্রেসের সামনে পাল্টাপাল্টি যুক্তি পর্ব শেষে সরকারের নির্দেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বাহামাস পুলিশ।

এ কারণে গত বছরের মার্চ থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারমূল্য কমেছে ৭০০ বিলিয়ন বা ৭০ হাজার কোটি ডলার। কয়েন মার্কেট ক্যাপের সূত্রে ফোর্বস জানাচ্ছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারমূল্য এক লাখ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি খাত থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্রিপ্টো স্টার্টআপগুলোর মূল্য কমে গেছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ক্রমাগত ধস নামছে ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারে। এরই মধ্যে একের পর এক ঘটনা আঘাত হেনেছে বাজারে। প্রথম দিকে বিশেষজ্ঞরা যেমন আশা করেছিলেন, তেমন ফল হয়নি।

মহামারির প্রকোপ কমতে শুরু করলে গত বছরের শুরুতে ক্রিপ্টোর বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। ধীরে হলেও মুনাফার মুখ দেখছিলেন বিনিয়োগকারীরা। এর পরই শুরু হয় সমস্যা। বিশ্বজুড়ে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রভাবে বাজার গতি হারায়। যেমন রাশিয়া–ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে তেলের দাম। সব মিলিয়ে ক্রিপ্টোর বাজারে একধরনের হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ কয়েনবেসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান আর্মস্ট্রংয়ের সম্পদমূল্য নেমে এসেছে ২২০ কোটি ডলারে। অথচ গত বছর তা ছিল ৬৬০ কোটি ডলার।

গত বছর কয়েনবেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাদের এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যে অর্থ পাচার হয়েছে, সেটা তারা ঠেকাতে পারেনি। সে জন্য তাদের পাঁচ কোটি ডলার জরিমানা দিতে হয়। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নিচ্ছে, যদিও তারা নিজেদের সম্পদ ও সেবার বৈধতার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তারা এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। আরও অনেক বিনিয়োগকারী এখন নজরদারিতে আছেন।

মানুষের আর্থিক লেনদেনে নজরদারি চালিয়ে যাতে সাধারণ মানুষের তথ্য সরকার না পায়, সে লক্ষ্যেই ক্রিপ্টোকরেন্সির ভাবনা শুরু। সরকারের নজর এড়িয়ে আর্থিক লেনদেনের জন্যই সমমনস্ক বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও হ্যাকাররা মিলে ক্রিপ্টো মুদ্রার জন্ম দেন।

ফলে ক্রিপ্টো নামের সঙ্গেই একধরনের গোপনীয়তা জড়িয়ে আছে। যেকোনো দেশের সার্বভৌম সরকার এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। গত বছর স্যামসহ ক্রিপ্টো মুদ্রার বিনিয়োগকারীদের ওপর যেভাবে নজরদারি চালানো হয়েছে, বিষয়টি তারই ইঙ্গিত দেয়।

এ প্রশ্নের জবাব এখনো পরিষ্কার নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি আবার পুরোপুরি স্বনির্ভরও নয়। ডলার, পাউন্ড খরচ করে বিটকয়েন কেনা যায়। সে জন্য দেশি বা বিদেশি সরকার যদি ক্রিপ্টোকারেন্সির বেচাকেনায় নিষেধাজ্ঞা বা এ নিয়ে আইন করে, তার প্রভাব বিটকয়েনের বাজারে পড়বেই।

বর্তমানে চার হাজারের বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো বিটকয়েন। এ ছাড়া এথেরিয়াম, টেথার, বিন্যান্স কয়েন, ইউএসডি কয়েন, ডজ কয়েন, কার্ডানো নামের আছে।