ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ব্যবসায় কীভাবে শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে ভারত
দেশে কিংবা বিদেশে ফাস্ট ফুডের মধ্যে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা আলুভাজা বেশ জনপ্রিয়। এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের মূল কাঁচামাল হচ্ছে আলু। বিশ্বে আলু উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। গত দুই দশকের চেষ্টায় দেশটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানিতে বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গুজরাট রাজ্যকে এখন ভারতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের রাজধানী বলা হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানিতে ভারতের উত্থানের বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ভারত থেকে হিমায়িত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানি দ্রুত হারে বাড়ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশটি ২০ হাজার টন হিমায়িত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানি করেছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে দেশটি থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টন, যা তার আগের এক বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি।
আলুচাষি যীতেশ প্যাটেল গুজরাটের এক কৃষক পরিবারের সন্তান। তাঁর পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে তুলা চাষ করত। তবে তুলা চাষ থেকে আয়–উন্নতি তেমন হচ্ছিল না। বিশেষ করে ২০০১ ও ২০০২ সালে খরার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। তখন যীতেশের পরিবার বুঝতে পারে, একটা পরিবর্তন দরকার। এ নিয়ে যীতেশ প্যাটেল বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা বুঝেছিলাম, এমন কিছু চাষ করতে হবে, যেটার জন্য অনেক পানির প্রয়োজন পড়ে না।’
সে সময় আলু চাষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে যীতেশের পরিবার। প্রথমে তাঁরা নিজেদের খাওয়ার জন্য সাধারণ আলু চাষ করেন। এই আলু স্থানীয় বাজারেও কিছু বিক্রি করা হয়। তবে আলু বিক্রি করে তুলার চেয়ে ভালো মুনাফা হচ্ছিল না।
এদিকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সালে গুজরাটে ব্যবসা শুরু করে। তখন যীতেশ প্যাটেলের পরিবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উপযোগী আলু চাষ শুরু করে। এর পর থেকে তাঁদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বলে জানান যীতেশ প্যাটেল।
এভাবে যীতেশ প্যাটেলের মতো আরও অনেকের ভাগ্য ফেরে আলু চাষে। এর কারণ ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের রপ্তানি বাজার দ্রুত বাড়ছে। গুজরাটকে এখন ভারতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। সেখানে রয়েছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের বড় বড় কারখানা। যেমন কানাডিয়ান জায়ান্ট ম্যাককেইন ফুডস এবং ভারতের বৃহৎ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদক হাইফান ফুডস।
গুজরাট থেকে বিশ্বজুড়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানি হয়। তবে তাদের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে এশিয়ার ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। এমন তথ্য দিয়ে আলুর বাজার বিশ্লেষক দেবেন্দ্র কে বলেন, এই সাফল্যের পেছনে মূল রহস্য হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক দাম। বৈশ্বিক বাজারে ভারতীয় হিমায়িত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলনামূলকভাবে সস্তা। ২০২৪ সালে ভারতীয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দাম ছিল চীনের চেয়েও কম।
গুজরাটে হাইফান ফুডসের সাতটি আলু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে তারা আরও দুটি কারখানা চালু করবে। এমন তথ্য দিয়ে হাইফানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হারেশ করমচন্দনী বলেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ব্যবসায়ে ভারত এখন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। পর্যাপ্ত ফলন, সাশ্রয়ী উৎপাদন খরচ ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে মনোযোগের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নগরায়ণ, বাড়তি আয় ও জীবনধারার পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে মানুষের মধ্যে হিমায়িত খাবারের চাহিদা বেড়েছে।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানিতে শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে দশকের পর দশক ধরে কাজ করতে হয়েছে ভারতের কৃষকদের। যীতেশ প্যাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আলু উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চলেছেন তিনি।
যীতেশ প্যাটেল বলেন, ‘আমরা সবাই শিক্ষিত কৃষক। আমরা নিত্যনতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে চলেছি।’
২০০৩ সালে শস্যের মাঠে পানি ঢালার পরিবর্তে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করেন গুজরাটের কৃষকেরা। মাটি উর্বর রাখতে তাঁরা গ্রীষ্মকালে জমি চাষ না করে ফেলে রাখেন। গরুর গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহার করেন। বর্তমানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উপযোগী একটি উচ্চ ফলনশীল যথাযথ আলুর জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন ভারতীয় কৃষকেরা।
যীতেশ প্যাটেল বলেন, ‘আমরা এখন বীজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। শিগগিরই নতুন একটি জাত নিয়ে আসব।’
অবশ্য শুধু আলুর উন্নত জাত নয়, হিমায়িত খাদ্য শূন্য ডিগ্রির নিচে সংরক্ষণ ও পরিবহনের ব্যবস্থায়ও এখন ঘাটতি রয়েছে, এমনটাই বললেন ভারতীয় খাদ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইন্দো অ্যাগ্রি ফুডসের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিজয় কুমার নায়েক।
বিজয় কুমার নায়েক বলেন, ‘ভারতের কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ হিমায়িত খাবার সংরক্ষণের উপযুক্ত। এসব সুবিধা আবার কিছু রাজ্যে কেন্দ্রীভূত। ফলে গ্রাম ও দূরবর্তী এলাকায় তা প্রায় নেই বললেই চলে। পরিবহনও বড় সমস্যা হয়ে আছে। বিশেষায়িত রেফ্রিজারেটেড ট্রাক ও কনটেইনারের ঘাটতির কারণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন করা কঠিন। অনেক অঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ–বিভ্রাট ঘটে, যা পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
বিজয় কুমার নায়েক আরও বলেন, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে রপ্তানি বাজারে চীন, থাইল্যান্ড ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। এসব দেশের লজিস্টিকস, অবকাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি উন্নত।