মুদ্রানীতির কৌশল নির্ধারণে ম্যারাডোনার ড্রিবলিংয়ের প্রয়োগ

ডিয়েগো ম্যারাডোনাছবি: টুইটার

বাঁ পায়ের ড্রিবলিংয়ে ফুটবল-দর্শকদের মোহিত করে রাখতেন বিশ্বসেরা ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর ছন্দময় দৌড়ের মধ্যে বোদ্ধারা সংগীতের প্রভাবও আবিষ্কার করতে পারেন, কিন্তু তাঁর এই ড্রিবলিং-দক্ষতা যে মুদ্রানীতির ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় তুলনার খোরাক হয়েছে, সেটা কজনই-বা জানেন।

ঘটনাটি ২০০৫ সালের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ অর্থাৎ নীতি সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিয়েগো ম্যারাডোনার এক গোলের তুলনা টানেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তৎকালীন গভর্নর লর্ড মেরভিন কিং। এর নাম দেন তিনি ম্যারাডোনা থিওরি অব ইন্টারেস্ট রেট। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যেভাবে অবিস্মরণীয় গোলটি দিয়েছিলেন; লর্ড কিং মনে করেন, মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত, ঠিক সেভাবেই খেলা। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ৬০ গজ দৌড়ে ইংল্যান্ডের গোলরক্ষকসহ পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সেই গোল দেন ম্যারাডোনা।

এর চেয়েও চমকপ্রদ বিষয় হলো, ম্যারাডোনা এই গোল করার জন্য একদম সোজা পথে দৌড়েছেন। পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটানোর পথে ম্যারাডোনা সোজা দৌড়ালেন কীভাবে? বিশ্লেষকেরা বলেন, ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা ভেবেছিলেন, ম্যারাডোনা ডানে-বাঁয়ে মোচড় দেবেন, সে জন্য তাঁরাও আগেভাগে ডান-বাঁ করেছেন। তাই ম্যারাডোনার পক্ষে সোজা দৌড়ানো সম্ভব হয়েছে। ফলে শেষমেশ গোল করতে তাঁকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

লর্ড কিং বলেন, ঠিক এখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেখার বিষয় আছে। ভবিষ্যতে নীতি সুদহার কেমন হবে, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের ধারণা তৈরি করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। এতে নীতি সুদহার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবর্তন না করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

২০০৫ সালের পর এখন ২০২৪ সাল চলছে; এই সময়ে ম্যারাডোনা তত্ত্ব বেশ ভালোই চলেছে। ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও কোভিড-১৯ মহামারির সময় নীতি সুদহার বেশ দীর্ঘ সময় ধরে শূন্যের কাছাকাছি ছিল। ওই সময়ে নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতি চাঙা করতে সুদহার কমিয়েছিলেন। স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদহার জোর করে কমাতে না পারায় অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ম্যারাডোনার মতো কৌশলের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের তারা বোঝাল, শিগগিরই নীতি সুদহার বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। এরপর কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি বন্ড ও অন্যান্য আর্থিক উপকরণ যেমন মর্টগেজ-ব্যাকড সিকিউরিটিজ (এমবিএস) ক্রয় করে কর্মসূচি চালু করে কেন্দ্রীয় বিপুল পরিমাণে বন্ড কিনে নেয়। এর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করা হলো যে এখন নীতি সুদহার বাড়ানো হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিপুল ক্ষতি হবে। এতে কাজ হয়ে গেল—দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদহার নিচে নেমে এল।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাতে এখন নানা কায়দা-কৌশল করার অবকাশ আছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা যেন ইংল্যান্ড দলের রক্ষণভাগের সেই খেলোয়াড়দের মতো; সুদের বাস্তব হারের চেয়ে ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়েই বেশি মাথা ঘামান। ২০২৩ সালের প্রথম ভাগে এই প্রবণতা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে। তাতে নীতি সুদহারও চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে। সম্প্রতি ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের ঘোষণায় সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। যদিও তিনি নীতি সুদহার পরিবর্তনের কথা বলেননি; বরং তিনি ঘোষণা দেন, ফেডের কর্মকর্তারা শিগগিরই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়েল আরও বড় দান মেরেছিলেন। বিনিয়োগকারীরা তখন আশা করছিলেন, শিগগিরই নীতি সুদহার কমানো হবে; তাঁর ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের সেই প্রত্যাশা একদিকে নিশ্চিত করা হলো, আরেক দিকে বন্ডের সুদহার কমে গেল এবং শেয়ারের দাম বেড়ে গেল। নীতি সুদহার প্রায় শূন্যের কোঠা থেকে বেরোনোর বছরখানেক পর ফেডের মুদ্রানীতির চেয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, খুব কম ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিক ঋণের সুদ বিদ্যমান নীতি সুদহারের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সুদহার নির্ধারিত হয় বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার ভিত্তিতে ও দীর্ঘমেয়াদি সুদহারের আলোকে। ফেডের সুদহারের লক্ষ্যমাত্রার আলোকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কল মানি দেওয়া-নেওয়া করে। এর ভিত্তিতেই ভোক্তা ও ব্যবসায়িক ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়। কারণ, ব্যাংকগুলো আর যা-ই করুক, তারা ভবিষ্যতে ফেডের কাছ থেকে যে রিভার্স রেপো হার পেতে পারে, তার চেয়ে কম হারে ঋণ দেবে না। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদহার নির্ভর করে বাজারভিত্তিক ভবিষ্যৎ সুদহার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার ওপর। বিনিয়োগকারীরা যদি প্রত্যাশা করেন যে ফেড নীতি সুদহার বাড়াবে, তাহলে স্বল্পমেয়াদি ঋণে তাদের যে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা পুষিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করে। মোদ্দাকথা, বর্তমান নীতি সুদহারের চেয়ে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এর মধ্য দিয়ে নতুন ঋণের সুদহার ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে দিকনির্দেশনা দিতে হলে যে দিকনির্দেশনা তাঁরা দিচ্ছেন, তার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। তবে বাস্তবতা বদলে গেলে কী করা দরকার বা কী করতে হবে, তা নিয়ে একধরনের দোদুল্যমানতা থাকে। সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন পরিস্থিতিতে কী নীতি নেওয়া হবে, তার একটি সম্ভাব্য রূপরেখা দিতে পারে। তাহলে বিনিয়োগকারীদের কাছে মুখ হারানোর কিছু থাকবে না। তবে শেষ বিচারে সবকিছু নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর; তখন এক কৌশলে কাজ হয় না। ম্যারাডোনাও যে এক কৌশলে সব সময় পার পেয়ে গেছেন, তা নয়।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট