পুতিনের ভারত সফর, কী থাকছে বাণিজ্যে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দিনের সফরে আজ ভারতে এসেছেন। এই সফরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে।
বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক বিরোধ তুঙ্গে, সেই সময় ভারতের পরীক্ষিত মিত্র রাশিয়া তার পাশে কতটা দাঁড়াতে পারে, বিশ্লেষকেরা তা দেখার অপেক্ষায় আছেন। এই সফরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন কিছু চুক্তি হতে পারে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি যেখানে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলার, সেখানে রাশিয়ায় তার রপ্তানি মাত্র ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন বা ৪৮৮ কোটি ডলার। গত পাঁচ বছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়লেও সেই বাণিজ্য মূলত রাশিয়ার দিকেই হেলে আছে। সেই সঙ্গে ভারত সম্প্রতি রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারতে আসছেন। খবর ইকোনমিক টাইমস ও দ্য হিন্দুর
গত অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে ভারত ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৮৭২ কোটি ডলার। সেখানে রাশিয়ার রপ্তানি ছিল ৬৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৮৪ কোটি ডলার।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বাস্তবতায় ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানো একপ্রকার অসম্ভব। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে এত দিন অনড় থাকলেও সম্প্রতি ট্রাম্পের কথামতো রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়েছে ভারত। তবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি। ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তখন রাশিয়া ভারতকে আশ্বস্ত করে, তারা ভারত থেকে আরও পণ্য কিনবে। ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই সে কথা বলেছিলেন। ভারত চায় রাশিয়ায় যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রীর রপ্তানি বাড়াতে। অন্যদিকে রাশিয়া চায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতে তাদের রপ্তানি বাড়াতে।
এই বাস্তবতায় রুশ প্রেসিডেন্টের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে বলা হয়, এই সফরে পুতিন ও মোদি রাশিয়া-ভারতের বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। রাজনীতি, বাণিজ্য, অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে বিশেষ ও অগ্রাধিকারমূলক কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় কি না, সেটাই এই সফরের লক্ষ্য।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, এই সফরে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়েও বেশ কিছু চুক্তি হতে পারে।
ভারতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অতিথি ফেলো আলেক্সিই জাকারভ বলেন, এই শীর্ষ বৈঠকের মূল লক্ষ্য হবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ খোঁজা। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যেন একতরফা রাশিয়ার দিকে হেলে না থাকে, সেই ব্যবস্থা করা।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার বহুমুখীকরণ
রাশিয়া ভারতের মূল অস্ত্র সরবরাহকারী, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র আমদানি কমিয়েছে। মূলত রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কেনার কারণেই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য একতরফাভাবে রাশিয়ার দিকে হেলে আছে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহুমুখীকরণের কথা ভাবছে দুই দেশ। গবেষণা সংস্থা চ্যাটহ্যাম হাউসের তথ্যানুসারে, পুতিনের এই সফরে শ্রমিক সরবরাহের লক্ষ্য চুক্তি হতে পারে। অর্থাৎ ভারতের শ্রমিকেরা যেমন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশে যাচ্ছেন, এই চুক্তি হলে দক্ষ ভারতীয় শ্রমিকেরা রাশিয়াও যেতে পারবেন। এই চুক্তির তাৎপর্য বোঝা কঠিন নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
ভারত-রাশিয়া ব্যবসায়ী ফোরামে দুই দেশের শিল্পসংগঠনগুলো সহযোগিতার আরও খাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে রুশ বাজারে ভারতীয় রপ্তানি বাড়ানো। কৃষি, প্রকৌশল ও পরিষেবা খাতে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল পরিষেবা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা বৃদ্ধি।
ডিডলারাইজেশন বা ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রাশিয়া-ভারত ভিন্ন মুদ্রায় লেনদেন করছে। ডলারের বাইরে দিরহাম, রুপি ও ইউয়ানে লেনদেন বেড়েছে। পুতিনের এবারের সফরে পেমেন্ট কাঠামো তৈরি করা নিয়ে আলোচনা হবে। রাশিয়ার এসপিএফএস সিস্টেম আরইউপেসহ ভারতীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করা নিয়েও বড় সিদ্ধান্ত হতে পারে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
ভারত বর্তমানে রাশিয়ায় যেসব পণ্য রপ্তানি করছে, সেগুলো হলো রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি, ধাতু, সবজি, প্রাণিজ পণ্য, প্লাস্টিক ও রাবার, চামড়াজাত পণ্য, নিট পোশাক, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
অন্যদিকে রাশিয়া থেকে ভারত যেসব পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে আছে সমরাস্ত্র, সার, বিটুমিন, জ্বালানি, মূল্যবান ধাতু, পাল্প, কাগজ, ধাতু ও উদ্ভিজ্জ তেল।
প্রতিরক্ষা
পুতিনের ভারত সফরে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বড় চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো। বিশেষ করে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিয়ে আলোচনা হবে। ‘অপারেশন সিঁদুরের’ সফলতায় ভারত সন্তুষ্ট। এরপর তারা আরও এস-৪-০০ কেনার কার্যাদেশ দিয়েছে। সেগুলো কবে সরবরাহ করা হবে, তা চূড়ান্ত হয়ে যাবে এই সফরেই।
পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের এসইউ-৫৭ যুদ্ধবিমান নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে। রুশ মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, অতিরিক্ত এস-৪০০ নিয়ে আলোচনাই অগ্রাধিকার পাবে। তবে এ কারণে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি আরও বাড়বে।
সোভিয়েত-উত্তর যুগে ব্যবসা বেড়েছে
ভারত ও রাশিয়ার কৌশলগত মিত্রতা অনেক পুরোনো। তবে সোভিয়েত–উত্তর যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত বেড়েছে। মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাসের তথ্যানুসারে, ১৯৯৫ সালে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল মাত্র ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৮৭০ কোটি ডলার।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো রাশিয়ার তেল ও গ্যাস, ওষুধ ও আইটি খাতে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার কোম্পানিগুলো ভারতের জ্বালানি, অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করেছে।