পুতিনের পরে সি চিন পিং, এরপর ইউরোপের নতুন বিপদ কি ডোনাল্ড ট্রাম্প

সি চিন পিং, ভ্লাদিমির পুতিন, ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

এক দশক আগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে জার্মানির রুয়র উপত্যকায় স্বাগত জানানো হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, এই অঞ্চলটি চীনের বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হতে পারে; ওই সময় চীন থেকে রাশিয়া হয়ে জার্মানিতে একটি ট্রেনও এসেছিল। সেই অঞ্চলের খনিশ্রমিকদের আয়োজিত অর্কেস্ট্রাও দেখেছিলেন তিনি।

বর্তমানে ফিরে আসা যাক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের চিত্র হচ্ছে, জার্মানির এক বন্দরে বিওয়াইডি এক্সপ্লোরার-১ নামে একটি জাহাজ থেকে তিন হাজার বৈদ্যুতিক গাড়ি খালাস করা হয়েছে। এই গাড়িগুলো চীনের কোম্পানি বিওয়াইডির তৈরি। জাহাজের নাম দেখে বোঝা যায়, এমন জাহাজ ভবিষ্যতে জার্মানির বন্দরে আরও নোঙর করবে। এই পরিস্থিতিতে জার্মানির মতো গাড়িশিল্পের অগ্রণী দেশে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে উচ্চ প্রযুক্তি খাতে বিপুল প্রণোদনা দিচ্ছে চীন। ফলে গাড়ি উৎপাদন অনেকটা বেড়েছে। উৎপাদন খাতে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এখন রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে এবং তা আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ইউরোপের নেতারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন, তাঁদের বাজার চীনের উন্নত ও সস্তা প্রযুক্তির পণ্য ছেয়ে যায় কি না এই ভেবে।

৫ মার্চ ইউরোপীয় কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের কাছে এখন এই মর্মে পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে যে চীন অন্যায্যভাবে বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্পে ভর্তুকি দিচ্ছে, অর্থাৎ চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট চীনকে এই বলে সতর্ক করেছেন যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে তারা যেন অর্থনীতির সব নিয়মকানুন জলাঞ্জলি না দেয়।

আগামী মে মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ফ্রান্স সফর করবেন। কূটনীতিকদের তরফ থেকে জানা গেছে, সেই সফরে বাণিজ্যের বিষয়ে কঠোর বার্তা দেবেন তিনি।

উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশগুলো চীনের রপ্তানি বাজারের ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলো ইউরোপের জন্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হুমকির কারণ হয়ে উঠছে। এর কারণ হলো ইউরোপের প্রবৃদ্ধির মডেলের কেন্দ্রে রয়েছে বাণিজ্য।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে উন্মুক্ত বাজার হচ্ছে ইউরোপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জিডিপির ৪৪ শতাংশ আসে পণ্য ও সেবা খাত থেকে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় যা প্রায় দ্বিগুণ। নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্লক হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুরক্ষামূলক শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্যবিধি ভাঙতে অনাগ্রহী। একই কথা ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যাদের মুক্ত বাণিজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।

ইউরোপের সময় ভালো যাচ্ছে না; এর মধ্যে এসেছে চীনের ধাক্কা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ইউরোপীয় শিল্প খাত দুই বছর ধরে জ্বালানি–সংকটে ভুগছে। এমন সময় যুদ্ধ শুরু হয়, যখন ইউরোপের নেতারা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধির চেষ্টা করছিলেন। প্রতি মেগাওয়াট–ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের দাম ছিল ২২ ইউরো, ২০২২ সালে তা ৩০০ ইউরোতে উঠে যায়। ফলে বিদ্যুতের দামও অনেকটা বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন নীতি সুদহার ৪ শতাংশে উন্নীত করতে বাধ্য হয়। এমনিতেই ইউরোপের অর্থনীতি তখন ভঙ্গুর ছিল; এর সঙ্গে উচ্চ নীতি সুদহারের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।

করোনা মহামারির সময় পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো ইউরোপ মহাদেশে নানা ধরনের আর্থিক ছাড় দেওয়া হয়েছে, সরকারের ব্যয় কমাতে হয়েছে।

জার্মানিতে বাজেট ঘাটতি কত রাখা যাবে তার সীমা অত্যন্ত কঠোর। ফলে চলতি বছর তারা ব্যয় হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে; ২০২৫ সালে আরও কাটছাঁট করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফ্রান্স সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৩ সালে তাদের বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশটির অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, ফ্রান্স সরকার অর্থনীতির ব্রেক চেপে ধরেছে, অর্থাৎ রাজস্বনীতি ঠিক রাখতে ১০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় কমানোর পথে যাচ্ছে তারা।

গত ২০১৯ সালের পরের সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ; একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ। ব্রিটেন ও জার্মানিতে মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃত অর্থে কমেছে। সরকারি পূর্বাভাসে জানা যাচ্ছে, চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের প্রবৃদ্ধির হার আরও শোচনীয় হয়ে ১ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে; এরপর কী হবে তা অনিশ্চিত।

করোনা মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বাড়লেও ইউরোপ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউরোপীয় নেতারা, চিন্তাশালা ও দুজন সাবেক ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, ঠিক কী কারণে ইউরোপ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়েছে। একই সঙ্গে এখন আরেক বিপদ আবির্ভূত হয়েছে। সেটা হলো চলতি বছরের নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হলে ইউরোপীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।

চীন ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার পর ইউরোপ একধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছিল। তখন চীন ইউরোপ থেকে উচ্চ প্রযুক্তি কিনত। এবারের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে চীন এখন পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা কাটানোর চেষ্টা করছে। শিল্প রোবট ও রেলওয়ের সরঞ্জামের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন স্বনির্ভরতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

এক দিকে চীনের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, আরেক দিকে তারা উচ্চ প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হতে চাইছে। এর অর্থ হলো চীনের মানুষ পশ্চিমা গাড়ি কেনা কমাবে এবং সেই সঙ্গে দেশটিতে কমবে পশ্চিমা যন্ত্রপাতি কেনা। অথচ ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ পাওয়ার পর চীনের কাছে ঠিক এসব পণ্য বিক্রি করে ইউরোপ নিজের রপ্তানি ঠিক রেখেছিল। ২০১৯ সাল থেকে চীনের রপ্তানি বাড়ছে। তবে সেটা তার জিডিপির তুলনায় খুব একটা বেশি না হলেও তার তোড়ে অনেক দেশের বাজার ভেসে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাবসলিউট স্ট্র্যাটেজির অ্যাডাম উলফ।

ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ হলো এখন অত্যাধুনিক পণ্যের বাজারেও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, নিজ দেশসহ সবখানেই।

গাড়িশিল্পের কথাই ধরা যাক, এই শিল্প ছিল একসময় ইউরোপীয় শিল্পের মধ্যে রত্ন। সরবরাহব্যবস্থাসহ এই খাতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপীয় বাজারের প্রায় ৯ শতাংশের হিস্যা এখন চীনের হাতে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও চীনা গাড়ির নিবন্ধন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় গাড়ির ব্র্যান্ডগুলো চীনের কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। ইউবিএস ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বৈশ্বিক গাড়ি বাজারে ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিগুলোর হিস্যা একসময় ৮১ শতাংশ থাকলেও ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৫৮ শতাংশে নেমে আসবে।

ইউরোপের চারদিকে এখন বিপদ। দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদের শিরোনাম এমন—‘ইউরোপস ইকোনমি ইজ আন্ডার অ্যাটাক ফ্রম অল সাইডস: ফার্স্ট পুতিন, নাউ সি, নেক্সট ট্রাম্প?’ অর্থাৎ ইউরোপ এখন বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপ কী করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।