চীন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অর্থনীতির সূচক দেখে যেভাবে বুঝবেন

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সদস্যরাফাইল ছবি: রয়টার্স

১৯৮০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মনে ভয় ছিল, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো পারমাণবিক হামলা চালাবে। সেই ভয় থেকে তারা কেবল যুদ্ধপ্রস্তুতির লক্ষণ খুঁজে বেড়াত। শুধু সামরিক নয়, অন্যান্য লক্ষণ দেখেও তারা বোঝার চেষ্টা করত, যুক্তরাষ্ট্রে ঠিক কী করছে। যেমন বড় ধরনের রক্তদান কর্মসূচি বা শিল্পকর্ম এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করত, যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালাল বলে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের সেই দিন গেছে। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। তাই এখনো বিশ্লেষকেরা সম্ভাব্য সংঘাতের লক্ষণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এখন যুদ্ধের সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে তাইওয়ান; যে ভূখণ্ড চীন নিজের বলে দাবি করে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সমর্থন করে।

চীন তাইওয়ানে হামলার চালানোর সামরিক প্রস্তুতি নিলে তা লুকানো কঠিন। তবে সেনা জড়ো হওয়া ছাড়াও অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের নানা লক্ষণ দেখেও চীনের অভিলাষ বোঝা যেতে পারে বলে মনে করা হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক সাধারণ ঘটনা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের অভিলাষ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখে অভিলাষ বোঝা আরও কঠিন। দেশটি কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে। তারা নিয়মিতভাবেই খাদ্য মজুত করে। সেই সঙ্গে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে তারা অর্থনীতিকে আরও নিশ্ছিদ্র করেছে। এসব দেখে মনে হতে পারে যে যুদ্ধের আশঙ্কার পালে হাওয়া লেগেছে, কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে যুদ্ধ আসন্ন।

এখন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ হলো, প্রকৃত অর্থে যুদ্ধ শুরুর আগে চীন ঠিক কীভাবে অন্যদের সন্দেহ দূর করার উদ্যোগ নেয়, তা চিহ্নিত করা।

এ ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেওয়ার আরেকটি জায়গা হলো পণ্য; যেমন জ্বালানি, খাদ্য ও ধাতু। যুদ্ধ শুরু করার আগে চীন এসবের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইবে। এসব পণ্যের অনেক কিছুই অন্য দেশ থেকে আমদানি করে চীন, রাষ্ট্র যার বড় ক্রেতা। সে কারণে বাণিজ্য পরিসংখ্যান বিবেচনা করে বোঝা যাবে, সরকারের উদ্দেশ্য কী।

যেসব লক্ষণ দেখে চীনের উদ্দেশ্য বোঝা যাবে, সেগুলো এমন: ধারাবাহিকভাবে এসব পণ্য বেশি বেশি কেনা, আমদানি-রপ্তানিতে হঠাৎ করে পরিবর্তন, বাজারের প্রবণতার বিপরীতে কেনাকাটা ও ঐতিহাসিক প্রবণতার বাইরে গিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। কোনো নির্দিষ্ট একধরনের তথ্য দেখে বোঝা যাবে না যে যুদ্ধ আসন্ন। তবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ এক করে সম্ভাব্য আগাম সতর্কতা পাওয়া যাবে।

জ্বালানি একটি বড় সূচক। যুদ্ধ করতে গেলে সামরিক বাহিনীর বিপুল জ্বালানি প্রয়োজন, সেই সঙ্গে সরঞ্জাম ও খাদ্য পরিবহনেও জ্বালানি প্রয়োজন। ফলে চীন যদি হঠাৎ করে জ্বালানি মজুত বাড়াতে শুরু করে, তাহলে সেটাকে যুদ্ধপ্রস্তুতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

তবে বিষয়টি অতটা সরল নয়; কারণ চীন এক দশক ধরে তেলের মজুত বৃদ্ধি করছে। দেশটি সংরক্ষণের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করছে। তবে যুদ্ধের সময় স্বাভাবিকভাবেই তাদের জ্বালানি ব্যবহার সামরিক কাজে সীমাবদ্ধ করতে হবে। এই লক্ষণ অবশ্য আগেভাগে পাওয়া যাবে না, তবে দেরিতে পাওয়া গেলেও তা যুদ্ধ প্রস্তুতির স্পষ্ট লক্ষণ।

যুদ্ধ কাছাকাছি চলে এলে চীনের আচরণে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, সেটি একটি প্রশ্ন। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, তখন তারা সম্ভব খাদ্য কেনা বৃদ্ধি করবে। সে ক্ষেত্রে সয়াবিনের দিকে নজর দিতে হবে। মূলত শূকরের খাবার হিসেবে চীনে এর ব্যবহার, যার ৮৪ শতাংশই দেশটি আমদানি করে। দেশটির মাংস চাহিদায় ৬০ ভাগই আসে শূকর থেকে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর কৃষি কর্মকর্তা গুস্তাভো পেরেইরা ইকোনমিস্টকে বলেন, চীন যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে সয়াবিন কেনে, তাহলে বুঝতে হবে, তারা শূকরের মাংস মজুত করছে, অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য আপৎকালীন খাদ্য সঞ্চয় করছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার খড়্গ এড়াতে দেশকে যথাসম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি সহযোগীদের সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এসব অনেক লক্ষণ অনেক দেরিতে পাওয়া যেতে পারে বা সব লক্ষণ যে অব্যর্থ হবে, তা–ও নয়। তবে জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গে সি চিন পিং সম্প্রতি বলেছেন, সামনে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। চীন যে কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা আবার ভুল করে অধিকতর খারাপ কিছুর জন্য ধরে নেওয়া হতে পারে। তবে চীনের কৌশলের একটি দিক হলো, তারা তাইওয়ান দখলের জন্য প্রস্তুত ও আগ্রহী। সেটা এখনই যে করবে, তা হয়তো নয়।

১৯৮৩ সালে ন্যাটো এক সামরিক মহড়া চালায়, যার চূড়ান্ত পর্বে সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলার সিমুলেশন ছিল। কেজিবি ভেবেছিল, এরপর তারা প্রকৃতই পারমাণবিক হামরা চালাবে। এখন চীন তাইওয়ানে হামলা চালানোর অনুশীলন করছে, সেটা দেখে পশ্চিমাদের এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। তবে সবকিছু দেখে যদি প্রকৃতই মনে হয় যে চীন যুদ্ধ করবে, তাহলে পশ্চিমারাই সম্ভবত চীনকে থামাতে পারবে।