বিশ্ববাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধির ধারা কত দিন চলবে

সোনার বারপ্রতীকী ছবি: রয়টার্স

বিশ্ববাজারে একটানা কিছুদিন মূল্যবৃদ্ধির পর গত সপ্তাহে সোনার দাম কিছুটা কমেছে। মূল্যবান এই ধাতুর দাম কমে চলতি সপ্তাহে প্রতি আউন্স ২ হাজার ১৫৫ ডলারে নেমেছে। দাম সামান্য কমলেও সার্বিকভাবে বিশ্ববাজারে সোনার দাম এখনো চড়া। চলতি বছরের মার্চ মাসে গত সপ্তাহ পর্যন্ত সোনার দাম ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সোনার দাম সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ শিগগিরই নীতি সুদহার কমাতে পারে—বাজারে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় চলতি মাসের শুরুর দিকে বুলিয়ন সোনার দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল এক শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে, এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়া থেকে খুব বেশি দূরে নেই ফেডারেল রিজার্ভ। ওই বক্তব্যের পর বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়ে গিয়েছিল। তবে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় এবং মার্কিন ডলার আরও শক্তিশালী হওয়ায় সোনার দাম কিছুটা কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমোডিটি ও আর্থিক বাজারের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় অনলাইন মাধ্যম ডেইলি এফএক্স ডটকম থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

জেরোম পাওয়েলের কথায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। এ কারণে সোনার দাম বেড়ে যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান প্রকাশের পর থেকেই পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করে। গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান অনুকূলে না আসায় ফেডারেল রিজার্ভ উল্টো ব্যবস্থা নিতে শুরু করতে পারে। তাতে বিনিয়োগকারীদের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আরও ধৈর্য ধরতে হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহার কমানোর পদক্ষেপ নিতে দেরি হতে পারে বা তা যতটা কমানোর ধারণা করা হচ্ছে, ততটা কমানো না–ও করা হতে পারে।

নীতি সুদহারের বিষয়ে আগামী বুধবার ফেডারেল রিজার্ভের পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে। সেদিন মার্চ মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে ফেডারেল রিজার্ভ। সেখানে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করবে সোনার বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের বিষয়টি।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ফেডারেল রিজার্ভ ইঙ্গিত দিয়েছে, চলতি বছর নীতি সুদহার ৭৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমানো হতে পারে। সম্প্রতি এই ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সোনার দাম ওঠানামা করেছে। এখন ফেডারেল রিজার্ভ যদি বলে চলতি বছর নীতি সুদহার খুব বেশি কমানো হবে না, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। নীতি সুদহার প্রত্যাশামাফিক না কমলে বন্ডের সুদহার বেড়ে যাবে এবং মার্কিন ডলারের বিনিময় হারও বেড়ে যেতে পারে; তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সোনার দাম আবার কমতে পারে।

গত সপ্তাহে সোনার দাম কমলেও এখনো তা প্রতি আউন্স ২ হাজার ১৫০ ডলারের ওপরে। এই পরিস্থিতিতে সোনা বিক্রির প্রবণতা যেন খুব বেশি বেড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে সোনার দাম এই সীমার মধ্যে রাখতে হবে বলে একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তা না হলে সোনার দাম ২ হাজার ৮৫ ডলারে নেমে আসতে পারে। বাজার আরও দুর্বল হলে সোনার দাম ২ হাজার ৬৫ ডলারেও নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদি তার উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা সোনা কেনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সোনার দাম ২ হাজার ২০৫ ডলারে উঠে যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নির্ভর করছে ফেডের ওপর। তারা কবে নীতি সুদহার হ্রাস করে, তার ওপর।

সোনার দাম কেন বাড়ে

সোনার ব্যবহার কেবল অলংকার তৈরির মধ্যে সীমিত নয়; বরং বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের সুদহার বাড়লে বা শেয়ারবাজার চাঙা হলে বিনিয়োগকারীরা তখন ব্যাংক বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মনোযোগী হন। তখন সোনার চাহিদা কমে যায়। যেমনটি দেখা গেছে ২০২২ ও ২০২৩ সালে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ডলারভিত্তিক বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমালে বন্ডের সুদহারও কমে যাবে, সে জন্য বিনিয়োগকারীরা আগেভাগে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন। সে জন্য কয়েক মাস ধরে সোনার দাম বাড়ছে।

এক দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা বাড়ছে, যদিও গত বছর আগের বছরের চেয়ে সোনা কেনা কিছুটা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
সোনার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির বিশেষ সম্পর্ক নেই বলেই গবেষকেরা মনে করেন। তাঁদের মতে, সোনার মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ ভয় ও আতঙ্ক। সেই ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে, সংকট এলেই সোনার দাম বাড়তে থাকে। গোল্ড প্রাইস ডটকমের তথ্যানুসারে, ১৯৭০ সালের সংকটের সময় সোনার দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলারে উঠেছিল। ১৯৮০ সালে সেই দর দাঁড়ায় ৬১৫ ডলারে। ১৯৯০ সালে সেটি অনেক কমে আবার ৩৮৩ ডলারে নেমে এসেছিল।