ইসরায়েলে হামলার পর ইরানের বিরুদ্ধে আর কী নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে

ছবি: এএফপি

ইসরায়েলে এক নজিরবিহীন হামলার পর ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার এ ঘোষণা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আসতে যাচ্ছে। ইরানের তেল রপ্তানির সক্ষমতা কমাতেই মূলত এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।

মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা ইরানকে নিয়ে বেশ কিছু বিল আনারও পরিকল্পনা করছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।

ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়। তেহরানের ওপর এরই মধ্যে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্ভাব্য আরও যেসব নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, সে সম্পর্কে জানিয়েছে রয়টার্স।

বর্তমান নিষেধাজ্ঞা

তেহরানের ওপর চলতি যেসব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ইরানের সব সম্পদ জব্দ রয়েছে, নিষিদ্ধ রয়েছে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া ও অস্ত্র বিক্রি। কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের (সিআরএস) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির আওতায় রয়েছে হাজার হাজার ব্যক্তি ও কোম্পানি। এসব নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু ইরানি এবং বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। গত বছরে সিআরএসের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন চাইছে ইরানের সরকারকে দমিত রাখতে এবং তার আচরণের পরিবর্তন করতে।

ইরানের যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে, তার মধ্যে আছে পারমাণবিক কর্মসূচি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুক্তরাষ্ট্র যেসব গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী বলে বিবেচনা করে, তাদের প্রতি তেহরানের সমর্থন।

আরও কী নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক কর্মকর্তা পিটার হ্যারেল মনে করেন, ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কিছু সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের তেল রপ্তানি এবং দেশটির বিভিন্ন কোম্পানি ও অর্থদাতাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো যায়। তিনি বলেন, একটি ব্যবস্থা হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওয়াশিংটনের মিত্রদের পক্ষ থেকে বহুজাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ। কারণ, বর্তমান বিধিনিষেধগুলো মূলত শুধু মার্কিনদের পক্ষ থেকে আরোপ করা।

তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল, তার আওতায় আগে আরোপ করা বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছিল। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান এবং নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় আরোপ করেন।

পিটার হ্যারেল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট থেকে আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। যদিও আমরা যেকোনো সময় আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারি; আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এমন এক পৃথিবীতে আছি, যেখানে অর্থনৈতিক চাপ আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে। কারণ, আমরা ইতিমধ্যেই অনেক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসে আছি।’

কংগ্রেস কী ভাবছে

বর্তমানে যেসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে, সেগুলো ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়ন করতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান সদস্যরা অভিযোগ করছেন। তাঁরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা যাতে কার্যকর হয়, সে লক্ষ্যে বেশ কিছু বিল আনা হবে।

এসবের মধ্যে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা পরিপালনের ক্ষেত্রে যে ছাড় আছে, সেগুলো ঠিকঠাকমতো পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখতে কংগ্রেসের নজরদারি জোরদার করা। এ ছাড়া ইরানে মার্কিন পণ্য ও প্রযুক্তির রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা এবং মানবিক কারণে নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিলে তা যেন সন্ত্রাসকে উসকে না দেয় বা বহু মানুষকে হত্যা করতে পারে, এমন অস্ত্রের বিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসন যেন নিশ্চিত হয়।

তবে এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে ঠিক কবে বা আদৌ এসব পদক্ষেপ আইনে পরিণত হবে কি না। এসব পদক্ষেপ আইনে পরিণত হতে হলে তা ডেমোক্রেটিক দল-নিয়ন্ত্রিত সিনেটে পাস হতে হবে এবং এরপর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তাতে স্বাক্ষর করতে হবে।

গত সোমবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ ইরান-চীন জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা আইন পাস করেছে। চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইরানি তেলের লেনদেনে অংশ নিচ্ছে কি না, এ আইনের আওতায় সে ব্যাপারে বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে হবে। কোনো চীনা প্রতিষ্ঠান এমন লেনদেনে অংশ নিলে মার্কিন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে হিসাব চালাতে পারবে না।

তবে সিনেটে এই বিল পাস হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। সিনেট অবশ্য নিজেই আলাদা আইনের বিষয় চিন্তা করতে পারে। সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি গত মঙ্গলবার একটি বিল পাস করেছে, যার আওতায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে যেসব বিদেশি বন্দর ও তেল শোধনাগার ইরানি তেল প্রক্রিয়াজাত করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

ইরান-সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে ২০২১ সাল থেকে বাইডেন প্রশাসন শত শত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বর্তমান নিষেধাজ্ঞায় কী আছে

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেগুলোর লক্ষ্যে রয়েছে দেশটির পারমাণবিক সক্ষমতা, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাত, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক এবং ইরানি অর্থনীতির বিভিন্ন খাত।

• ইরানের পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা ও অন্যান্য কোম্পানি, যাঁরা দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

• ইরানের জাতীয় তেল কোম্পানি, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর লক্ষ্য, তেল বিক্রি থেকে এসব প্রতিষ্ঠান যাতে রাজস্ব পেতে না পারে।

• ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী, তাদের বৈদেশিক কুদস ফোর্স, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনীর লজিস্টিকস এবং এদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর মধ্যে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ও কুদস ফোর্সকে বৈদেশিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ওয়াশিংটন চিহ্নিত করেছে।

• প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং ইরানের সরকারি কর্মকর্তাদেরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।