ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ: যে কারণে ভিয়েতনামের নতুন নেতা দরকার

মার্কিন-চীন দ্বৈরথ দেখে এশিয়ার অধিকাংশ দেশই যখন থরহরিকম্প, তখন ভিয়েতনাম একে দেখে সুযোগ হিসেবে। ১০ কোটি মানুষের এই দেশ উভয় পরাশক্তিরই ঘনিষ্ঠ। দেশটির ভৌগোলিক কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক। চীনের দক্ষিণ সীমান্তে তার অবস্থান, সেই সঙ্গে তার উপকূল আছে তিন হাজার কিলোমিটার। সে কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ভিয়েতনামকে তোয়াজ করে।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ভিয়েতনামই ছিল পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যেটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং উভয়ই সফর করেছেন। ভূকৌশলগত গুরুত্বের কারণেই এটা ঘটেছে। বাইডেনের সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের কোস্টগার্ডকে জলযান দিয়েছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়া ও চীনের কাতারে বিবেচনা করে।

ভিয়েতনামের তরফ থেকে এটি খুবই কুশলী ভারসাম্যপূর্ণ খেলা, যেখান থেকে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই লাভবান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে সরে যাওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, তার আলোকে বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য দেশে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের এই চায়না প্লাস ওয়ান নীতির সবচেয়ে বেশি ফসল ঘরে তুলছে ভিয়েতনাম, এশিয়ার অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায়।

ভিয়েতনামের সুবিধা হলো সস্তা শ্রম ও বিদেশি বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষা। সে কারণে ২০ বছর আগের চীনের সঙ্গে অনেকেই এখন ভিয়েতনামের মিল খুঁজে পান, তবে দুটি বিষয় বাদে। সেগুলো হলো, জোরজবরদস্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি। জোরজবরদস্তির বিষয়টি যে একেবারে নেই তা নয়, তবে পরিমাণে কম।

পশ্চিমাদের সঙ্গে যতই সম্পর্ক ভালো হোক না কেন, ভিয়েতনাম এখনো চীনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সে দেশে যে উৎপাদকেরা কাজ করেন, তাঁরা মূলত চীনের উপকরণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ভিয়েতনামের অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত হলে চীনের বিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা নেই, বরং বিষয়টি উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে বলেই ধারণা করা যায়। ২০২৩ সালের প্রথম তিন ত্রৈমাসিকে ভিয়েতনাম তার জিডিপির অনুপাতে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের দ্বিগুণ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে।

ইকোনমিস্টের মতে, এই দেশগুলোর উচিত ভিয়েতনামের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া, যারা আজ থেকে ৪০ বছর আগে অর্থনীতি উন্মুক্ত করেছে। ভিয়েতনামে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষুধার কবলে থাকায় একপর্যায়ে যৌথ মালিকানার অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসে। ফলাফল—দেশটির মাথাপিছু আয় ছয় গুণ বেড়ে ৩ হাজার ৭০০ ডলারে উঠেছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এটা সম্ভব হয়েছে।

ভিয়েতনাম যে কেবল মার্কিন-চীন সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবনতির কারণে সুবিধা পাচ্ছে তা নয়, বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আগেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভিয়েতনামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। চীনে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে বিনিয়োগকারীরা ভিয়েতনামের বিষয়ে আগ্রহী হন। সম্প্রতি অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলো সে দেশে আসায় সরবরাহব্যবস্থায় ভিয়েতনামের উত্তরণ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের মূল রপ্তানি পণ্য এখন আর কেবল টেক্সটাইল বা বস্ত্র নয়, সেই জায়গা নিয়েছে আইফোন। দেশটিতে এখনো কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে, যদিও দ্য ইকোনমিস্ট বলছে যে এরা শুধু নামেই কমিউনিস্ট, যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪৫ সালের মধ্যে দেশটিকে ধনী দেশে রূপান্তরিত করা।

তবে ভিয়েতনামের এই যাত্রা একেবারে মসৃণ নয়। এশিয়ার আরেকটি বাঘ হয়ে ওঠার পথে অনেক ঝুঁকি আছে দেশটির। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যদি তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে সরব হন, তাহলে বিপদে আছে। ভিয়েতনামের উপকূল ও দক্ষিণ বদ্বীপ অঞ্চলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে আছে। যে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা এত দিন সুবিধা পেয়ে এসেছে, তা–ও খুব বেশি দিন থাকবে না। ধারণা করা হচ্ছে, এক দশকের কিছু বেশি সময় পরে দেশটির কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে।

এ ছাড়া শাসকগোষ্ঠী যতই আশাবাদী হোন না কেন, রাজনৈতিক সংস্কারের পথে এখনো যেসব বাধা রয়ে গেছে, তা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সংস্কারের পথে প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি গত মাসে খুব প্রকটভাবে দেখা গেছে। তখন হঠাৎই দেশটির প্রধান নেতা ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এনগুয়েন ফু ট্রং অদৃশ্য হয়ে যান। সামাজিক মাধ্যমে জল্পনাকল্পনা ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মারা গেছেন। তবে শেষমেশ তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে আবির্ভূত হন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কারণে বিনিয়োগকারীরা তত দিনে প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন। ওই অভিযানের অংশ হিসেবে শেষ পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্টকেও বরখাস্ত করা হয়।

এখন এনগুয়েন ফু ট্রং পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে যখন শঙ্কা আছে, তখন বিনিয়োগকারীদের মনে শঙ্কা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যেতে পারে।

আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত এনগুয়েন ফু ট্রংয়ের অবস্থান পর্যালোচনার হওয়ার কথা নয়। তবে ইকোনমিস্ট মনে করছে, তাঁর উচিত এই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানো। দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে তারা মনে করে। সেটা অনেক বড় চাওয়া। তবে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের উচিত, ভিয়েতনামের ভবিষ্যতের জন্য তিনি যে হুমকি হয়ে উঠেছেন, অন্তত সেটা বোঝা। তাঁর উচিত, এখন দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে একজন প্রয়োগবাদী উত্তরসূরি নির্বাচন করা।