ফাতিমার জুতা কেনা আর ইন্দোনেশিয়ার বদলে যাওয়ার গল্প
ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের এক দূরবর্তী গ্রামের বাসিন্দা ফাতিমা ভেবে পাচ্ছিলেন না, আত্মীয়ের বিয়েতে কী জুতা পরে যাবেন। যতটা তিনি মনে করতে পারেন, জুতা কিনতে হলে একসময় কাঠের নৌকায় এক ঘণ্টা ধরে নদী পার হয়ে বাজারে যেতে হতো।
কয়েক বছর আগে মুঠোফোন আসার পর অবশ্য বাস্তবতা বদলেছে। এখন প্রায় প্রতিদিন তিনি ‘শপি’ নামের এক ই–কমার্স অ্যাপ ব্রাউজ করেন। ফলে এখন তিনি হাজার হাজার মাইল দূরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন; বদৌলতে অনেকটা জাদুর মতো তাঁর বাড়ির দোরগোড়ায় পার্সেল হাজির হয়।
তবে বিষয়টি জাদু নয়। ফাতিমার ফোনে অ্যাপের যে আলোকোজ্জ্বল আইকন থাকে, তার পেছনে নির্মাতা, মোড়কজাতকারী ও পণ্য পরিবহনকারীদের বিশাল নেটওয়ার্ক কাজ করে। এরা কেউ কাউকে চেনে না। এমনকি ফাতিমাও কাউকে চেনেন না। কিন্তু এদের পারস্পরিক নির্বিঘ্ন সমন্বয়ের কারণে ফাতিমা যা চাইছেন, নিজের দোরগোড়ায় তা পেয়ে যাচ্ছেন। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ ও শতাধিক ভাষার দেশ ইন্দোনেশিয়ার মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে।
এই গল্পের শুরু মানুষের ইচ্ছার মধ্য দিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ফাতিমা সাদা রঙের ফিতা ছাড়া জুতা কিনতে চেয়েছিলেন। অনলাইন শপিং কার্টে তা ছিল, কিন্তু ২৫ ডলার দিয়ে সেই জুতা কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। ফাতিমার স্বামী স্থানীয় বাজারে পেনটল বিক্রি করেন। পেনটল একধরনের মিটবল, যা পিনাট সস ও আটা দিয়ে বানানো হয়। গৃহস্থালির ব্যয় মেটাতে তিনি প্রতিদিন ফাতিমাকে তিন ডলার দেন। সেখান থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে ফাতিমা ছোটখাটো জিনিস কেনেন। এরপর হঠাৎ করেই ফাতিমার ফোনে বার্তা এল যে তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্যান্ডেল অর্ধেকের বেশি ছাড়ে ১২ ডলারে বিক্রি হবে। সঙ্গে সঙ্গে তা লুফে নেন ফাতিমা।
অ্যাপে সেই স্যান্ডেল কেনার কার্যাদেশ দিতেই হাজার মাইল দূরে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার উপকণ্ঠে বোগোর শহরে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এই জুতা তৈরি করেছে প্র্যাট্রিস। পারিবারিক এই ফার্ম ২০২০ সাল থেকে অনলাইনে বেচাকেনা শুরু করে। অর্থাৎ কোভিড–১৯–এর সময় তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। তিন বছর আগে এই ফার্মের মালিক রিকো আন্তোনিয়াস ও মারিয়া পুত্রি অ্যানাসতাসিয়া ৫০ জন কর্মীকে নিয়োগ দেন। ২০২৩ সালে তাঁরা গড়ে দৈনিক এক হাজার জোড়া জুতা চালান করেন। তাঁদের অধিকাংশ ক্রেতাই ফাতিমার মতো ৪০ বছরের কম বয়সী নারী।
রিকো দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, শুরুর দিকে বিক্রির কলাকৌশল তাঁরা জানতেন না। তবে এখন তাঁরা জানেন যে কী করতে হবে। সেটা আর কিছু নয়—লাইভ স্ট্রিমিং। ১০ জন তরুণী দিনরাত ২৪ ঘণ্টা একাধিক পালায় জুতার গুণাগুণ বর্ণনা করে লাইভ স্ট্রিমিং করেন। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বুথে বসে তাঁরা ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাঁদের কিনতে প্ররোচিত করেন।
বিক্রয়কর্মী সিতি জাহরা অ্যামেলিয়া বলেন, বিক্রয়কর্মীদের নিজস্ব ধরন আছে, কেউ একটু বেশি উৎসাহী, কেউ আবার শান্তশিষ্ট ও ধীরস্থির প্রকৃতির। যেসব গ্রাহক অনলাইনে লাইভ স্ট্রিমিং দেখেন, তাঁদের অধিকাংশই তরুণী। তবে তাঁদের মধ্যে অনেক পুরুষও থাকেন, যাঁরা স্ত্রীর জন্য পণ্য কিনতে পরামর্শ চান।
ফাতিমার অর্ডার ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাৎক্ষণিক চলে আসে। এর কারণ হলো, গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়ায় ভৌত অবকাঠামোর বিপুল উন্নতি হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো মনে করেন, সমৃদ্ধির উপায় হচ্ছে কংক্রিটের ঢালাই করা পথ। গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়ায় তিন লাখ কিলোমিটারের বেশি সড়ক নির্মিত হয়েছে; সেই সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ বন্দর ও ২৫টি নতুন বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে। এসব কাজে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন বা ১৮ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসব কারণে ইন্দোনেশিয়ায় পণ্য সরবরাহ অনেক সহজ হলেও প্রক্রিয়াটি এখনো অনেক জটিল।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে গন্তব্যের শেষ ও প্রথম প্রান্ত নিয়ে চিন্তা করতে হয়, কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী পথও অনেক চ্যালেঞ্জিং। শপি ই–কমার্সের প্রধান হান্ধিকা জা জা বলেন, ইন্দোনেশিয়ার একাংশে এখনো ভালো সড়ক গড়ে ওঠেনি, এমনকি সেখানে পোস্ট কোড বা ঠিকানাও নেই। স্থানীয় সরবরাহকারীদের বাসা খুঁজতে হয় নানা কায়দা করে, যেমন নীল মসজিদ থেকে তিনটি বাড়ি পরে বা বড় গাছটি থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে দুই বাড়ি পরে।
হান্ধিকা জা জা আরও বলেন, মোটরসাইকেল নিয়ে সরবরাহকারীরা সব জায়গায় যেতে পারেন। মাঝখানে জলপথ বা নদী পেরোতে সাম্পানে বাইক ওঠাতে হয়, সেই সরু পথ আবার অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আবার কখনো কখনো জল-কাদার মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে তাদের চলাচল করতে হয়। তারপরও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম এই বাজারের ই-কমার্স খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আসছে এবং দেশটি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ই-কমার্স খাতের জন্য পরীক্ষণভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এক দিক থেকে এটি বিশ্বায়নের জয়ের গল্প। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ই–কমার্স খাত গড়েই উঠত না। যে শপি থেকে ফাতিমা জুতা কিনেছেন, সেটি প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক ফার্ম। আটটি দেশে কাজ করে শপি। এর মূল কোম্পানির সদর দপ্তর সিঙ্গাপুরে, যার আংশিক মালিকানা চীনের মহিরুহ প্রযুক্তি কোম্পানি টেনসেন্টের হাতে।
আপাত অর্থে এটি বিশ্বায়নের জয়ের গল্প হলেও বাস্তবতা কিন্তু জটিল। দেশটি একই সঙ্গে বিশ্বায়নকে গ্রহণ করেছে এবং আবার তা প্রতিহত করারও চেষ্টা করে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো কিছুটা সুরক্ষাবাদী প্রকৃতির; একই সঙ্গে তিনি চীনের বিষয়েও কিছুটা সতর্ক। অক্টোবর মাসে তিনি শপির প্রতিদ্বন্দ্বী টিকটক শপ নিষিদ্ধ করেন। এ ছাড়া আমদানি করা পণ্যের মূল্য ১০০ ডলারের নিচে হলে ই–কমার্সে তা বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন তিনি। লক্ষ্য হলো, প্যাট্রিসের মতো স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বাজার সুবিধা দেওয়া।
দেশের রাজধানী জাকার্তায় বসে প্রেসিডেন্ট নীতিগত কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফাতিমার মতো গ্রামবাসীরা সে বিষয়ে তেমন খোঁজখবর রাখেন না। কিন্তু ই-কমার্সগুলো যেভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন নতুন বৈচিত্রপূর্ণ পণ্য নিয়ে আসছে, তাতে মানুষ যারপরনাই খুশি। অনেক পণ্য তাঁদের জীবনে প্রকৃত আনন্দ নিয়ে এসেছে। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন যে প্রযুক্তির প্রসারের মধ্য দিয়ে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে—জীবিকার সুযোগ।