শত পণ্যের মূল্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ আমদানি পণ্যের দাম কী হবে

চলতি ও আগামী বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এই সুখবর খুব বেশি স্বস্তির বার্তা বয়ে আনতে পারবে না। কারণ, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, তুলার মতো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়বে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে দেশে আগামী এক-দুই বছর মূল্যস্ফীতি কতটা কমবে—তা নিয়ে সংশয় আছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম সার্বিকভাবে ৩ শতাংশ কমবে। আর ২০২৫ সালে এসব পণ্যের দাম কমবে ৪ শতাংশ—এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে বলে মনে করে এই বৈশ্বিক সংস্থাটি।

তবে স্থানীয় উৎপাদনের বাইরে কোন দেশ কী ধরনের পণ্য কী পরিমাণ আমদানি করে—তার ওপর মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১০০ অতি প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম আগামী দুই বছরে কতটা বাড়তে পারে বা কতটা কমতে পারে, সেই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক কমোডিটি আউটলুক প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের উল্লেখ করা পণ্যের তালিকা ধরে বাংলাদেশ যে ১০টি নিত্যপণ্য তুলনামূলকভাবে বেশি আমদানি করে, তা পর্যালোচনা করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অনুসারে, ওই ১০টি পণ্যের মধ্যে ৬টি পণ্যের দাম কমবে, আর বাকি ৪টির দাম বাড়বে। দাম কমতে পারে এমন ছয়টি পণ্য হলো ইউরিয়া সার, কয়লা, এলএনজি, চিনি, গম ও ভুট্টা। আর দাম বাড়তে পারে জ্বালানি তেল, পাম তেল, সয়াবিন তেল ও তুলার। দেশের প্রধান আমদানি পণ্য তালিকায় এই ১০টি পণ্য বিশাল জায়গা দখল করে আছে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিনি, গম, ভুট্টার মতো খাদ্যপণ্যের কম কমতে পারে, এটা আমাদের জন্য সুখবর। আমরা চাল আমদানি করি না। তবে গমের ওপর অনেক নির্ভরশীল। তাই খাদ্য পণ্যের দাম কমলে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কমবে। সাধারণ মানুষের জন্য এটি স্বস্তিকর হবে।’

মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ‘জ্বালানি তেল মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এমনিতেই বেশি আছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত। এখন যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর আমাদের হাত নেই।’

পূর্বাভাস ও আমদানির চিত্র

বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৩ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম গড় দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি সাড়ে ৮২ ডলার। চলতি বছরে তা বেড়ে ৮৪ ডলার হতে পারে। তবে আগামী বছর তা কমে ৭৯ ডলার হতে পারে। জ্বালানি তেল আমদানিতেই সরকার সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের হিসাবে ৪৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, এ বছর এই খরচ আরও বাড়তে পারে।

দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ আমদানি পণ্য হলো তুলা। এটি বস্ত্র খাতের মূল কাঁচামাল। বিশ্বব্যাংক বলছে, আগামী দুই বছর তুলার দাম বাড়বে। এ বছর প্রতি কেজি তুলার দাম উঠতে পারে ২ দশমিক ১৫ ডলারে। আগামী বছর তা আরও ৫ সেন্ট বাড়তে পারে। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের তুলা আমদানি হয়েছে।

পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছরে প্রতি টন পাম তেলের দাম ২০-২১ ডলার বাড়তে পারে। প্রতি টনের তেলের গড় দাম হতে পারে ৯০৫ ডলার। অন্যদিকে সয়াবিন তেলের দামও বৃদ্ধির কথা বলছে বিশ্বব্যাংক। বর্তমানের টনপ্রতি ১ হাজার ১১৯ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ১৩০ ডলার হতে পারে সয়াবিন তেলের দাম। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০-৩৫ লাখ টন পাম তেল ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়। গত অর্থবছরে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে।

এবার দেখা যাক, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে কোন পণ্যের কত দাম কমছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরিয়া সারের দাম টনপ্রতি ৩৫৮ ডলার থেকে কমে ৩৫০ ডলার হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার সার আমদানি হয়েছে। এবার একটু কম খরচ হতে পারে। একইভাবে এলএনজি এবং কয়লার দামও কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, কয়লার দাম ব্যাপক কমতে পারে। ২০২৩ সালে প্রতি টন কয়লার গড় দাম ছিল প্রায় ১৭৩ ডলার। চলতি অর্থবছরে এর গড় দাম হতে পারে ১২৫ ডলার। অন্যদিকে প্রতি বিএমএমটিইউ এলএনজির দাম ১৪ দশমিক ডলার থেকে কমে সাড়ে ১২ ডলার হতে পারে।

চিনি হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্য। দেশে চিনির চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করে মেটাতে হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, চিনিতে সুখবর আছে। প্রতি কেজি দশমিক ৫২ ডলার থেকে কমে দশমিক ৫০ ডলার হতে পারে। একইভাবে প্রতি টন গমের দামও ৩৪০ ডলার থেকে কমে ২৯০ ডলার হতে পারে। পোলট্রি ফিডের জন্য বিপুল পরিমাণ ভুট্টা আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দামও কমতে পারে।

গত অর্থবছরে দেশে ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল ও তুলা আমদানিতেই এক-তৃতীয়াংশ অর্থ খরচ হয়।