আরও কঠোর হলো চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ
চীনের সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের ওপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁদের বিদেশি যোগাযোগও খতিয়ে দেখা হবে।
চীন সরকারের নোটিশ ও বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১২ জনের বেশি ব্যক্তির সূত্রে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে বেইজিং যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের পদক্ষেপ চীন সরকারের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আগেও ছিল। ২০২১ সালে এসব নিষেধাজ্ঞার আওতা একবার বাড়ানো হয়। যেসব বিষয় তখন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, বছরে ভ্রমণের সংখ্যা ও প্রতিবার ভ্রমণে কত দিন থাকা যাবে, তার সীমা আরও কঠোর করা, ভ্রমণের অনুমোদন পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা এবং সেই সঙ্গে ভ্রমণের আগে কর্মকর্তাদের গোপনীয়তা রক্ষা–বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া।
চীনের সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এসব বিষয়ের সঙ্গে কোভিড-১৯-এর কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে চীন সরকার ঠিক কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে রয়টার্সের সূত্রগুলো বিভিন্ন রকম কথা বললেও একটি বিষয়ে তাদের কথার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা হলো, বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর। এ কারণে চীনের যেসব সরকারি কর্মকর্তা বা যাঁরা রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কাজ করেন, তাঁরা নাম প্রকাশ না করা শর্তে রয়টার্সের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলাপ করেছেন।
এ ছাড়া রয়টার্স গত দুই বছরে চীন সরকারের অন্তত আটটি সংস্থার ঘোষণা খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে জাতীয় পেনশন তহবিলের একটি ঘোষণা আছে। এসব ঘোষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরও কঠোর করা হচ্ছে, যদিও সেখানে বিস্তারিত তেমন কিছু বলা হয়নি।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তির বিবৃতি ও সরকারি নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চীনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে কর্মীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখছে।
এ বিষয়ে দুজন বিশ্লেষক জানান, চীন সরকারের এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জাতীয় নিরাপত্তা ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সম্প্রতি গত কয়েক মাসে বেইজিং দেশের নাগরিকদের গোয়েন্দা তৎপরতাবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে তারা নতুন আইন প্রণয়ন করে গোয়েন্দাবৃত্তির সংজ্ঞা আরও বড় করেছে।
এ বিষয়ে এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর চায়না অ্যানালাইসিসের চীনা রাজনীতিবিষয়ক ফেলো নেইল টমাস রয়টার্সকে বলেন, চীনের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে ক্রমেই ভ্রম বাড়ছে। তারা মনে করছে, এটা আটকানোর পথ হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
এর সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের যোগ আছে বলেও মনে করেন নেইল টমাস। তিনি বলেন, পশ্চিমাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার চেয়ে সি চিন পিং এখন দেশের ভেতর থেকে চিন্তা বের করে আনার পক্ষপাতী।
তবে জাতীয় তথ্য কাউন্সিল বা রাষ্ট্রীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা কমিউনিস্ট পার্টি—এরা কেউই বিষয়টি সম্পর্কে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দিতে চায়নি।
চীনে বরাবরই ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। রাষ্ট্রের নির্বাহী পদে যাঁরা কাজ করেন এবং যাঁদের কাছে রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য থাকে, তাঁদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা অনেক আগে থেকেই আছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব নিষেধাজ্ঞা এখন চীনের নিচের পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর আরোপিত হচ্ছে, যারা সংখ্যায় প্রায় ৭০ লাখ। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কারখানার সাত কোটি কর্মীর ওপরেও এই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ–বিষয়ক ২০১৫ সালের নথি রয়টার্সের হাতে এসেছে।
বেইজিং ও সাংহাইয়ে চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের নিচের সারির কর্মীরা ব্যক্তিগত কারণে বছরে মাত্র একবার বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন এবং তার মেয়াদ ১২ দিন। দুজন ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে এ তথ্য দিয়েছেন। তাঁরা উভয়ই বলেছেন, সরকারের তরফ থেকে অভূতপূর্ব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
সেই সঙ্গে এই কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বিদেশ সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যে সরকারি কর্মকর্তারা কথা বলেছেন, তাঁদের ভাষ্য, কমিউনিস্ট ইয়ুথ লিগ, চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কমিটি (সিপিপিসিসি), স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও তাদের কর্মীরা সরকারি কর্মকর্তাদের বারবার জেরা করছেন, প্রশ্নমালা পাঠাচ্ছেন।
প্রশ্নমালায় জানতে চাওয়া হচ্ছে, বিদেশি নাগরিকত্ব আছে বা স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার আছে, এমন কোনো আত্মীয় তাঁদের আছে কি না। সেই সঙ্গে তাঁদের বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বা বিদেশ থেকে তাঁরা কী ধরনের সহায়তা পান, সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের অভিজ্ঞতা তাঁদের এই প্রথম।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে বিদেশ থেকে ভালো কিছু শিখে আসা কঠিন হবে। অন্য দেশের সমাজ সম্পর্কে ভালোভাবে না জানলে চীন সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবেন, সে বিষয়েও তাঁরা অজ্ঞ থেকে যাবেন।