শেষ পর্যন্ত পিছু হটলেন এরদোয়ান, তুরস্কে বেড়েছে সুদের হার

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি: রয়টার্স

শেষ পর্যন্ত সুদের হার বাড়ানোর পথেই হাঁটল তুরস্ক। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ যখন সুদের হার বাড়িয়ে চলছিল, তুরস্ক তখন সুদের হার কমিয়েছে। ফলাফল হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুরস্ক ছেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, প্রথাগত মুদ্রানীতি চালু থাকলে তাঁরা আবার হয়তো তুরস্কে ফিরবেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বড় ব্যবধানে বাড়ানোর পর গত বৃহস্পতিবারই দেশটির মুদ্রার লিরার দাম ৭ শতাংশ বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার এখন ২৫ শতাংশ। একবারেই সুদহার বাড়ানো হয়েছে ৭৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট। এই বৃদ্ধি যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তার তিন গুণ বেশি।

তুরস্কের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে আনতে তাঁরা আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। এর প্রথমটি হলো, আগামী মাসে একটি ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রকাশ, যা অনিশ্চয়তা কমাবে। অন্যটি হলো, বিদেশে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করা।

অর্থমন্ত্রী মেহমেত সিমসেক আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে গোল্ডম্যান স্যাকসের সদর দপ্তরে একটি বিনিয়োগ রোডশো করবেন। এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ রোডশো নিয়ে পরিকল্পিত একটি কর্মসূচি শুরু হবে।

বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত পাঁচ বছরে যে অপ্রচলিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্থির নীতি অনুসরণ করছিলেন, তার ফলে বিনিয়োগকারীরা তুরস্ক ত্যাগ করেন। এরদোয়ানের নীতির মধ্যে ছিল, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে সুদের হার কমানো।

পাঁচজন বিদেশি বিনিয়োগকারী অবশ্য রয়টার্সকে বলেছেন, নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কাজের স্বাধীনতার দিকে ইঙ্গিত করছে। মনে হচ্ছে, দেশটির মুদ্রার ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কমানো এবং মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয়ে নীতিনির্ধারকেরা এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন।

লন্ডনে একজন পোর্টফোলিও ম্যানেজার ভিক্টর জ্যাবো বলেন, ‘সুদের হার বাড়ানো দেখে এই প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে যে তাঁরা তাঁদের ভুলগুলো শুধরে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে এটা একটা ইঙ্গিত যে তাদের মুদ্রার ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে।’

বিনিয়োগ কোম্পানি ভ্যান একের উপপ্রধান পোর্টফোলিও ম্যানেজার ওলা এল-শাওয়ারবি বলেন, তাঁরা পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আগের চেয়ে বেশি স্বস্তি পাচ্ছেন, তাই তাঁরাও গঠনমূলক হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রচলিত ব্যবস্থা ফিরে আসছে বলে আমরা যত বেশি প্রমাণ পাব, আমরা বিনিয়োগ নিয়ে তত বেশি এগিয়ে যেতে পারব।’

এরদোয়ানকে নিয়ে প্রশ্ন
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস ও অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে টানাপোড়েনে মুখে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অর্থমন্ত্রী হিসেবে মেহমেত সিমসেককে বেছে নেন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আসেন সাবেক ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকার হাফিজে গায়ে এরকান। এরদোয়ানের উদ্দেশ্য হলো, পরিস্থিতির পরিবর্তন করা। হাফিজে এরকান হলেন তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম নারী গভর্নর।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডেট ইলমাজ ব্যাংকারদের বলেছেন, আগামী মাসের ‘মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি’ অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিশ্চয়তার বিষয়ে আরও ভালো ধারণা দেবে। একই সঙ্গে আগামী তিন বছরের জন্য সামষ্টিক পূর্বাভাসও পাওয়া যাবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আয়োজন করা রোডশো থেকেও তথ্য পাওয়া যাবে।

মেহমেত সিমসেক তাঁর সহকর্মীদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে তিনি যেসব পরিকল্পনা নিয়েছেন, তার পেছনে রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে। আর এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো আগামী বছরের মে মাস নাগাদ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা।

রিসেপ এরদোয়ান গত চার বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চারজন গভর্নরকে বরখাস্ত করেছেন। তিনি অবশ্য সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

লস অ্যাঞ্জেলেসের সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি টিসিডব্লিউর গবেষক ব্লেইজ অ্যান্টিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে আনতে তুরস্ককে খুব তাড়াতাড়ি আবারও সুদের হার বাড়াতে হবে। প্রশ্ন হলো, এটা চালিয়ে যেতে তাঁরা এরদোয়ানের সবুজ সংকেত পেয়েছেন কি না।’

গত সপ্তাহের শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, প্রয়োজন হলে সুদের হার আরও বাড়ানো হবে। মার্কিন ব্যাংক জেপিমর্গান পূর্বাভাস দিয়েছে যে বছরের শেষে সুদের হার ৩৫ শতাংশে উঠতে পারে।

সম্ভাব্য পদক্ষেপ
চলতি বছরের শেষে মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশের কাছাকাছি উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তুরস্কে গত মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৮ শতাংশ। সুতরাং সুদহার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার কমাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয় মুদ্রা লিরা নিয়ে সংকট ও পুঁজির অঘোষিত নিয়ন্ত্রণের পর দেশটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অভ্যন্তরীণ বন্ড বাজারে ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদেশিদের হাতে এখন তুরস্কের বন্ডের ১ শতাংশের কম রয়েছে। ২০১৯ সালে তা ছিল ১০ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২০ শতাংশ। গত তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১১ কোটি ডলার, আর বেরিয়ে গেছে ১৭০ কোটি ডলার।

বিনিয়োগকারী ও কর্মকর্তারা বলছেন, সুদের হার বাড়ানোর পর তুরস্কের শেয়ার, ইউরোবন্ড ও সিডিএস বাজার চলতি ও আগামী বছরে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতে চলেছে। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ এসেছে, ফলে দেশটির রিজার্ভ বেড়েছে।

লন্ডনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান নিউবারজার বারম্যানের পোর্টফোলিও ম্যানেজার কান নাজলি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের কাছে শেষ বিচারে সুদের হার গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না, সেটি জানাও তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে পরিবর্তন ঘটছে, তা দেখতে পাওয়া একটি ইতিবাচক ব্যাপার।’

গত জুন থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক খানিকটা করে সুদের হার বাড়াচ্ছিল। এ পর্যন্ত এই হার ১ হাজার ৬৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। তবে এর বাইরেও আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের একটি চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে করের হার বাড়িয়েছে, পণ্য ও সেবার অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়েছে, আমানতের মূল্যমান কমে যাওয়া ঠেকাতে যে বিশেষ সুবিধা চালু করা হয়েছিল, তা থেকেও পিছিয়ে আসা শুরু করেছে। এই সুবিধা দেওয়ার কারণে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছিল।

এ ছাড়া চলতি হিসাবে সম্ভাব্য ঘাটতি মোকাবিলায় তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে আরও দুই হাজার কোটি ডলার যোগ করা হয়েছে।

ইয়েনি সাফাক সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী মেহমেত সিমসেক বলেছেন, তাঁরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনেক সুবিধা দিচ্ছেন, তবে এ ক্ষেত্রে ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা বিধিবিধানভিত্তিক নীতিমালা অনুসরণ করব।’

নিউইয়র্ক ও জাতিসংঘে যেসব বৈঠক হবে, তাতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর মেহমেত সিমসেক লন্ডন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক অনুষ্ঠানে মরক্কো যাবেন। এরপরের বৈঠকগুলো হবে জাপান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ে। সব কটি বৈঠকই চলতি বছরের মধ্যে শেষ হবে।