জলদস্যুতায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। ২৩ নাবিক, ক্রুসহ জাহাজটি জিম্মি করেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরাছবি: সংগৃহীত

আরব সাগরে হঠাৎ সোমালি জলদস্যুদের আক্রমণ খুব বেড়ে গেছে, যা গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ‘হর্ন অব আফ্রিকা’খ্যাত সোমালি উপকূলের চারপাশে জলদস্যুতা তীব্রভাবে বেড়েছে। সর্বশেষ তিন মাসে তারা যে হারে বিভিন্ন দেশের জাহাজে আক্রমণ করেছে, তা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জলদস্যুতার ঘটনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। খবর সিএনবিসির

সোমালিয়ার জলদস্যুরা সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করে। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন।

এদিকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করছে। এর সঙ্গে নতুন করে সোমালীয় জলদস্যুদের আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র পরিবহনে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এবং খাতটি চাপের মধ্যে পড়েছে। হুতি বিদ্রোহী ও সোমালি জলদস্যুদের আক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের জাহাজ কোম্পানি, নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসরকারি সুরক্ষা কোম্পানি ব্যস্ত রয়েছে।

সমুদ্রগামী পরিবহনের ক্ষেত্রে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’খ্যাত সোমালি উপকূল থেকে ভারতীয় উপকূল পর্যন্ত এলাকাকে একটি ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যপথ হওয়ায় এই পথের সুরক্ষা নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেরই উদ্বেগ রয়েছে, যেমন এই পথের সুরক্ষায় ভারত ক্রমাগতভাবে নিরাপত্তা বাড়াচ্ছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও নজরদারির জন্য ভারতে ৩৯৯ কোটি মার্কিন ডলারের ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোমালিয়ার জলদস্যুদের আক্রমণের ঘটনা বন্ধে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাতটি প্রস্তাব পাশ করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। একই সঙ্গে বিদেশি নৌ ও বিমানবাহিনীকে সোমালিয়ার জলসীমায় প্রবেশ ও টহল দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নৌবাহিনীর অভিযান আটলান্টা এখন অঞ্চলটিতে কাজ করছে।

সমুদ্রে জলদস্যুতা বাড়ছে

২০১১ সালে সোমালি জলদস্যুরা ২১২টি হামলা চালায়। এটি ছিল আগের কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১১ সাল-পরবর্তী গত কয়েক বছরে দস্যুতার পরিমাণ অবশ্য অনেক কমেছে। তবে সম্প্রতি তা আবার বেড়েছে।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই) নামের একটি স্বাধীন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের মতে, গত তিন মাসে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে সোমালীয় জলদস্যুতা অনেক বেড়েছে। এটি গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দস্যুরা জাহাজ ও যাত্রীদের ছিনতাই করে উচ্চ মুক্তিপণ দাবি করছে।

জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো (আইএমবি)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩ সালে সমুদ্রপথে ১২০টি জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, যা এর আগের বছর ছিল ১১৫টি। একই সময়ে জাহাজের ক্রুদের জিম্মি ও অপহরণ করার ঘটনাও বেড়েছে।

আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গিনি উপসাগরেও জলদস্যুতার ঘটনা বেড়েছে। গিনি উপসাগরে ২০২৩ সালে ২২টি জলদস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ২০২২ সালে ১৯টি, ২০২১ সালে ৩৫টি ও ২০২০ সালে ৮১টি দস্যুতার ঘটনা ঘটে। এশীয় অঞ্চলে অবস্থিত সিঙ্গাপুর প্রণালিও এখন দস্যুতার উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) একজন মুখপাত্র সিএনবিসিকে বলেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহনের ওপর পুরো বিশ্বই নির্ভরশীল। ফলে সমুদ্রগামী জাহাজ ও কার্গো কোনো ধরনের আক্রমণের বিষয় হওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে নির্দোষ নাবিকদের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা উচিত।

অর্থনৈতিক ক্ষতি কত

জলদস্যুতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনেক বেশি ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জলদস্যুতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়।

সামুদ্রিক নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান অ্যাম্ব্রের মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের প্রধান বিশ্লেষক ড্যান মুলার জানান, গত নভেম্বর থেকে সোমালীয় জলদস্যুতা–সংক্রান্ত ঘটনায় প্রায় ২০ শতাংশের লক্ষ্যবস্তু ছিল বাণিজ্যিক জাহাজ। এমনকি মাছ ধরার জাহাজগুলোতেও আক্রমণ করছে জলদস্যুরা। এসব জাহাজের বেশির ভাগই ইরানের।