বন্ড কী, কীভাবে কাজ করে, ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতের সঙ্গে সম্পর্কই–বা কী

গ্রাফিক্সপ্রথম আলো

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক–যুদ্ধ বাজারে রীতিমতো ভীতি সৃষ্টি করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় মন্দার আশঙ্কা বেড়েছে। কিন্তু এসব কারণে যে ট্রাম্প ৯ এপ্রিল একদম উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছেন, তা নয়। যে ২ এপ্রিল তিনি স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করলেন, সেই স্বাধীনতার ফল ভোগের বিষয়টি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ভিন্ন এক কারণে।

বিষয়টি হলো, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্ববাজারে পতনের পাশাপাশি মার্কিন সরকারি বন্ড বিক্রির হারও প্রথাবিরুদ্ধভাবে বেড়ে গেল, তার জেরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই বন্ড প্রকৃতপক্ষে কী জিনিস, বন্ডের বেচাকেনাও বা কীভাবে হয়, এই সংকটের কেন্দ্রীয় জায়গায় বন্ডই–বা কেন উঠে এল?

বন্ড কী

বন্ড একধরনের প্রত্যয়নপত্র বা সার্টিফিকেট। কারও হাতে এই প্রত্যয়নপত্র থাকার অর্থ হলো, তিনি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই ঋণের অর্থ তিনি ফেরত পাবেন। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে সুদও দেওয়া হয়। যে বিনিয়োগকারীরা স্থিরতা চান অর্থাৎ নির্দিষ্ট মুনাফা চান, তাঁদের জন্য এই বন্ড।

অর্থব্যবস্থায় করপোরেশনগুলো যেমন বন্ডের বিনিময়ে ঋণ নেয়, তেমনি সরকারও বন্ড ছেড়ে ঋণ গ্রহণ করে। এই অর্থ দিয়ে সরকার বিনিয়োগ বা প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করে। বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন নামে এই বন্ড ছেড়ে থাকে, যেমন যুক্তরাজ্য সরকারের বন্ড গিল্টস নামে পরিচিত; মার্কিন সরকারের বন্ড ট্রেজারি নামে পরিচিত। এই ট্রেজারি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি পরিচালনাকারী সরকার এই বন্ডের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। বিভিন্ন মেয়াদে এই বন্ড ছাড়া হয়, যেমন ২ বছর, ১০ ও ৩০ বছর।

কীভাবে বন্ডের কেনাবেচা হয়

এই বন্ড শেয়ারের মতো বাজারে কেনাবেচা করা যায়। কিন্তু শেয়ারের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো, বন্ডের প্রাপ্য নির্ধারিত, যেখানে শেয়ারের দাম বাজারে প্রতিনিয়তই ওঠানামা করে। বন্ডের বাজার বিশ্বের বৃহত্তম সিকিউরিটিস এক্সচেঞ্জ—১৩০ ট্রিলিয়ন বা ১ কোটি ৩০ লাখ কোটি ডলারের বাজার এই বন্ডের। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড।

সরকারের বন্ড সাধারণত নিলামের মাধ্যমে করপোরেশনের কাছে বিক্রি করা হয়। এরপর সেকেন্ডারি বাজারে এর অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি দামে এই বন্ড বিক্রি করা যায়।

বন্ডের সুদহার কী

বন্ডের সুদহার ইংরেজিতে ইন্টারেস্ট নয়; বরং ইল্ড নামে পরিচিত। বন্ডের দাম যখন কমে যায়, তখন সুদহার বেড়ে যায়। অর্থাৎ চাহিদা কমে গেলে সরকার বিক্রি বাড়াতে সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এর অর্থ হলো, বিনিয়োগকারীরা বন্ডের বিষয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন। নানা কারণেই তা হতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, বন্ড যারা ছাড়ছে, তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা। সরকারি বন্ডের বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যাওয়ার অর্থ হলো, অর্থনীতি বা অর্থব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া।

মূল্যস্ফীতির ধারণাও বন্ডের সুদহারে প্রভাব ফেলে। মূল্যস্ফীতির কারণে মুনাফার গুড় পিঁপড়ায় খায় কি না, সেই আশঙ্কা থেকে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এর অর্থ হলো, ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিনিয়োগকারীরা বাড়তি সুদ চাইতে পারেন। অন্যান্য আর্থিক পণ্য, যেমন বন্ধকি ঋণের সুদ বন্ডের সুদহারের ওপর নির্ভর করে বলে বৃহত্তর অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়তে পারে।

ট্রাম্পের শুল্কের কারণে বন্ডের কী হয়েছে

ট্রাম্প প্রথমে ভেবেছিলেন, শুল্কের ঘোষণা আসার পর শেয়ারবাজারে সূচকের পতন হবে বা ডলারের বিনিময় হার কমে যাবে। তিনি ভেবেছিলেন, বছরের শেষ ভাগে শুল্কের অর্থ দিয়ে কর হ্রাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। এর অর্থ হলো, মার্কিন সরকার বন্ড ছাড়ার পরিমাণ সীমিত করে দেবে অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সামগ্রিকভাবে সরকারের ঋণে লাগাম পরাবে।

কিন্তু শুল্ক ঘোষণার পর যেভাবে মন্দার আশঙ্কা জেঁকে বসল, তাতে মার্কিন সরকারকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়া চীনের সঙ্গে যেভাবে বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এই দেশের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থবির হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণে মার্কিন বন্ড ছেড়ে দেওয়া শুরু করেন। এতে বন্ডের যেমন দাম কমে যায়, তেমনি সুদহারও বেড়ে যায়। ফলে মার্কিন সরকারের পক্ষে ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

ট্রাম্পের কী হলো

এই পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউসেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বেশি সুদে বন্ড বিক্রি করতে হলে তো সরকারি ঋণ ও ঘাটতি বাড়বে। এমনিতেই মার্কিন সরকার ঋণে জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে ব্যয় আরও বাড়লে পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে।

আরও গুরুতর বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ ট্রিলিয়ন ডলারের ট্রেজারির বাজার বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি। বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণে বন্ড ছেড়ে দিলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়বে এবং তাতে বড় পরিসরে আর্থিক সংকট হবে।

এখন ট্রাম্পের বিপদ হলো, তাঁর নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। আগামী বছর মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উঠতে পারে। সেটা হলে রিপাবলিকান দলের যে সমর্থকেরা তাঁকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তাঁরা বিগড়ে যেতে পারেন। ট্রাম্প যে ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্যের রাশ টেনে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। বন্ডের সুদহার বাড়তি থাকলে বন্ধকি ঋণের সুদহারও বাড়বে। মানুষ মনে করতে পারে, এই শুল্ক কার্যত একধরনের কর। তখন তাঁর জনপ্রিয়তায় চিড় ধরতে পারে।