কেন কমানো হলো যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান

যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: রয়টার্স

দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে ফিচ রেটিংস। এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, হোয়াইট হাউস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফিচ তাদের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেছে যে নতুন ঋণমান নির্ধারণে তাদের বিবেচনার বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিপুল ঋণের বোঝা’।

মার্কিন এই ঋণমান নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন রিচার্ড ফ্রান্সিস। ফিচের এই প্রধান বিশ্লেষক সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যা বলার সংখ্যাই বলছে’। যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় জাতীয় ঋণের হার হলো ১১৩ শতাংশ, যাকে ফ্রান্সিস বর্ণনা করেছেন ‘স্পষ্টতই বড় উদ্বেগ’ হিসেবে।

ফিচের খাতায় আমেরিকার ঋণমান ছিল ‘এএএ’, যাকে বলা হয় নিখুঁত ঋণমান। ফিচ এখন তা কমিয়ে করেছে ‘এএপ্লাস’। রিচার্ড ফ্রান্সিসের মূল উদ্বেগের জায়গাটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি এবং সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশটির ঋণ পরিশোধের জন্য পাহাড়সম খরচ।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঋণমান কমানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই হোয়াইট হাউস, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কিছু নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী ইয়েলেন জেনেট একে ‘স্বেচ্ছাচারী ও পুরোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ফিচ যেসব সূচকের ওপর নির্ভর করে তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তার অনেকগুলোতে অগ্রগতি হয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জেসন ফারম্যান ফিচের সিদ্ধান্তকে ‘পুরোপুরি অবাস্তব’ হিসেবে বর্ণনা করেন। আর সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ ল্যারি সামার্স বলেন, ঋণমান কমানো ‘অদ্ভুত ও উটকো’ পদক্ষেপ এবং এটা এমন সময় এসেছে, যখন অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করছে।

এর জবাবে রিচার্ড ফ্রান্সিস বলেন, আগামী কয়েক মাসে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে, শুধু তা দেখে ঋণমান কমানো হয়নি, বরং এ ক্ষেত্রে আরও গভীরভাবে চিন্তা করা হয়েছে।
রিচার্ড ফ্রান্সিস আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগামী মাসগুলোতে একটি মৃদু মন্দায় পড়বে, না কি তা সামান্য ব্যবধানে এড়িয়ে যাবে, ‘কেবল তার কারণেই কাটা নড়েনি’।

মধ্যপন্থীদের ধস

আর্থিক খাতে যে অব্যবস্থাপনা আছে, তার বাইরেও চিন্তা করেছেন রিচার্ড ফ্রান্সিস। বিশেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশের রাজনীতির অবস্থা তাঁকে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি গত ২০ বছরে শাসনব্যবস্থার অবনমন হয়েছে। সেই কারণে আমাদের আস্থা কমে গেছে যে শেষ পর্যন্ত সরকার রাজস্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে।’

এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা ও চিকিৎসাসেবা–সংক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা। এসবের সমাধানের জন্য প্রয়োজন হতে পারে রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং সমঝোতার পথে হাঁটা। ফ্রান্সিস উল্লেখ করেন, কংগ্রেসের বাজেট অফিস জানিয়েছে যে সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল ২০৩৩ সালের মধ্যে কমে যাবে।

রাজনীতির ‘দুই দিকেই যে মেরুকরণ’ ঘটেছে, সে ব্যাপারে সতর্ক করেন রিচার্ড ফ্রান্সিস।
‘ডেমোক্র্যাটরা বাঁয়ে সরেছেন। রিপাবলিকানরা অবশ্যই আরও ডানে ঝুঁকেছেন। আর মধ্যপন্থা ধসে পড়েছে। এসবের কারণে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ সত্যিকারভাবে মোকাবিলার জন্য আমরা খুব কম আগ্রহ দেখছি,’ বলেন তিনি।

৬ জানুয়ারির ঘটনা

প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের মার্কিন কংগ্রেসে হামলার ঘটনা ফিচের ঋণমান কমানোর সিদ্ধান্তে কতটা ভূমিকা রেখেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে রিচার্ড ফ্রান্সিস বলেন যে এটা তাঁদের সিদ্ধান্তের পেছনে ‘খুব বেশি’ ভূমিকা রাখেনি।

তবে রিচার্ড ফ্রান্সিস বলেন, ‘এটা কেবল পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ কতটা মারাত্মক হয়েছে। এটা আরও দেখিয়েছে যে সার্বিকভাবে শাসনব্যবস্থার অবনমন ঘটেছে।’ ঋণসীমা নিয়ে যে দফায় দফায় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, তা এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ বলে মনে করেন তিনি।

সিএনএন এর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে ঋণমানে সম্ভাব্য পতন নিয়ে ফিচ মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল এবং সেই আলোচনায় ৬ জানুয়ারির ঘটনাকে একটি উদ্বেগ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। রিচার্ড ফ্রান্সিস সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

মঙ্গলবারের ওই সন্ধ্যাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এক মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টার সঙ্গে ওই মামলা সম্পর্কিত। তবে ফ্রান্সিস বলেন, ফিচের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য একই সময় ঠিক করা ছিল ‘সম্পূর্ণ কাকতালীয়’। ঋণমান কমানোর সিদ্ধান্ত এক দিন আগেই নেওয়া হয়েছিল বলে তিনি জানান।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের শাসন পরিস্থিতি নিয়ে ফিচের যে উদ্বেগ, তার সঙ্গে ঋণমান কমানোর সময়টি মিলে গেছে বলে একমত হন প্রতিষ্ঠানটির বিশ্লেষক।

ঋণমান কমানোর বিষয়টি দ্রুতই একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। ডেমোক্র্যাটরা এর জন্য রিপাবলিকানদের দায়ী করেন। আর রিপাবলিকানরা দায়ী করেন ডেমোক্র্যাটদের।

তাহলে কোন রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য বেশি দায়ী, এমন প্রশ্নে রিচার্ড ফ্রান্সিস মনে করেন যে একে অপরকে দায়ী করার চেয়েও এ ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি কিছু বিবেচনা করার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আর্থিক ক্ষেত্রে সমস্যার পেছনে দুই দলেরই দায় রয়েছে।’

তবে রিচার্ড ফ্রান্সিস যোগ করেন, ট্রাম্পের কর কমানোর কারণে গত কয়েক বছরে রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন যে বিপুল অর্থ খরচ করছে, তার হয়তো প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এটাও ব্যয়বহুল একটি পদক্ষেপ।