তেল গ্যাসেই সমৃদ্ধি, এখন বহুমুখীকরণের চেষ্টায় কাতার

ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো কাতারের অর্থনীতিও তেল-গ্যাসভিত্তিক। এখন তারা অর্থনীতির বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে। মূলত উৎপাদন, পর্যটন, লজিস্টিকস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য খাতের ওপর ভর করে কাতার এখন প্রতি বছর তেল-গ্যাস বহির্ভূত খাতে চার শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায়। ২০২৩ সালের মধ্যে তারা এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায়।

ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তৃতীয় ধাপে আছে এখন কাতার। এই সময় তারা বিনিয়োগ বান্ধব অর্থনীতি তৈরি করতে চায়। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি দেশটি স্থানীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে চায়। চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২৩ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায় দেশটি। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে সে দেশে এফডিআই এসেছিল ৭৬ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

তেল গ্যাসেই সমৃদ্ধি

কাতার এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হলেও এক সময় তারা গরিবই ছিল। ১৯৪০ সালে কাতারে তেল আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে বদলে যেতে শুরু করে অর্থনীতি। মরুভূমির বালুরাশির নিচে তেলের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসও খুঁজে পায় কাতার।

১৯৪০ সালে শুরু হওয়া পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের ওপর ভিত্তি করে কাতারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ননঅ্যাসোসিয়েটেড গ্যাস ক্ষেত্র (শুধু গ্যাস, তেল নয়) দ্য নর্থ ফিল্ড সে দেশে অবস্থিত।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাসের ভান্ডার হলো কাতার। প্রায় দুই হাজার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুত আছে সে দেশে। ফলে বিশ্বের মোট গ্যাস সম্পদের প্রায় ১২ ভাগই আছে কাতারে। শুষ্ক প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে কাতার বিশ্বে ষষ্ঠ আর এলএনজি রপ্তানিতে দ্বিতীয়।

তবে কাতার সবচেয়ে লাভবান হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকরণের ব্যবসায়; এই পদ্ধতির নাম লিকুইফ্যাকশন বা তরলীকরণ। তরলীকৃত গ্যাস বড় বড় জাহাজে তেলের মতো পরিবহন করা যায়। গ্যাসকে তরলে পরিণত করার পর অনেক কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।

১৯৮৪ সালে এলএনজি তৈরিতে যৌথ উদ্যোগে কাতারগ্যাস নামের এক কোম্পানি গঠন করে। এটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম এলএনজি উৎপাদনকারী। ১৯৯৬ সালে তারা প্রথম এলএনজি কারখানা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। এরপর সে বছরের শেষ দিকে প্রথম এলএনজিবাহী জাহাজ কাতার ছেড়ে জাপান ও স্পেনের উদ্দেশে রওনা হয়।

পরবর্তীকালে দেশটি এই প্রযুক্তিতে আরও বিপুল অর্থায়নের ফলে তাদের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়।

ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপের এলএনজি কেনা বেড়ে যাওয়ায় কাতার কিছুটা বিপাকে পড়েছে। এমন একসময় এই পরিবর্তন ঘটছে, যখন কাতারের গ্যাস তরলীকরণের সক্ষমতা বাড়ছে। এখন তাদের বার্ষিক সক্ষমতা ৭ কোটি ৭০ লাখ টন; ২০২৭ সালে যা ১২ কোটি ৬০ লাখ টনে উন্নীত হওয়ার কথা।

আর্থিক খাত

জ্বালানি বিক্রি করে বিপুল অর্থ আয় করে কাতার। এই অর্থ কাজে লাগানোর জন্য গঠন করা হয়েছে ‘কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি’। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে তেল-গ্যাস বিক্রি করে আয় করা অর্থ দেশ-বিদেশের লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা।

কাতারের এই তহবিলের অর্থ বিশ্বের প্রতিটি কোনায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। হোটেল, অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট কেনার মাধ্যমে লন্ডনের বেশ বড় একটা অংশ কাতারের মালিকানায়; যুক্তরাষ্ট্রেও বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের তালিকায় কাতারের অবস্থান চার নম্বরে।

পুঁজিবাজারকে আরও আকর্ষণীয় করতে কাতার নতুন নতুন বিনিয়োগ মাধ্যম তৈরি করছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা কাতারে পুঁজিবাজারে আসছেন।

এ ছাড়া কাতারের আর্থিক খাতের সফলতার বড় আরেকটি কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ব্যাংক কাতার ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০২৩ সালে নর্থ ফিল্ড এক্সপ্যানশন বা সম্প্রসারণ প্রকল্পে অর্থায়ন করে কাতার ন্যাশনাল ব্যাংক। সেই সঙ্গে এই ব্যাংক এ ধরনের আরও প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে।

ফুটবল বিশ্বকাপ

সম্প্রতি কাতার সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে বিশ্ব কাপ ফুটবল আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ২০২২ সালে এই বিশ্বকাপ আয়োজনে ৩০ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে দেশটি। দ্য ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বকাপ ফুটবলের বদৌলতে কাতারের অর্থনীতিতে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের মতো যুক্ত হয়েছে। দেশটি এ আয়োজনে যে খরচ করেছে, তা মূলত ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণে। এই ফুটবল বিশ্বকাপের আসর নিয়ে কাতারের অনেক সমালোচনা হলেও শেষমেশ তারা সফলভাবে তা আয়োজন করে। আর্থিকভাবে তা খুব একটা লাভজনক না হলেও এতে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।