সিকি শতাব্দীর বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অনন্য বন্ধন গড়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, এই বন্ধন প্রকৃত অর্থেই অনন্য। কারণ, তাদের মধ্যে যে যৌথ উদ্যোগ গড়ে উঠেছে, তা রীতিমতো মহিরুহ।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে একধরনের দোকান হিসেবে বিবেচনা করে। পরিষ্কার করে বললে, সব দোকানের মধ্যে সবচেয়ে বড় দোকান। চীন থেকে তারা বিপুল পরিমাণে সস্তা পণ্য কিনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো চীনকে কম খরচে পণ্য উৎপাদনের কারখানা হিসেবে রীতিমতো শোষণ করেছে। অর্থাৎ, এমন এক জায়গায় তারা পণ্য উৎপাদন করেছে, যেখানে শ্রমিকের মজুরি যেমন কম, তেমনি ইউনিয়নও নিষিদ্ধ।
নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এতে চীনেরও লাভ হয়েছে। মার্কিন পরিবারগুলো যেমন চীনে তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে আসবাব কিনেছে, তেমনি কারখানা হওয়ার সুবাদে চীনের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বিনিময়ে চীনের নেতারা রপ্তানির ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড কিনেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র কম সুদে ঋণ পেয়েছে এবং পরিণামে দেশটির নাগরিকদের খরুচে স্বভাব অব্যাহত থেকেছে, যদিও তাঁদের আয়বৃদ্ধির ধারা থেমে গেছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। ভৌগোলিকভাবে দেশ দুটির মধ্যে যেমন বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর, আদর্শিকভাবেও তারা পরস্পরের বিপরীত মেরুর। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের প্রকৃতি মুক্ত বিহঙ্গের মতো, যেখানে চীনে চলছে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদী শাসন। তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এমন এক বন্ধন গড়ে উঠেছে যে অর্থনীতির ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসন ‘চিমেরিকা’ নামের একটি শব্দবন্ধ উদ্ভাবন করেছেন। অর্থনীতিতে তাদের মধ্যে যে মিথোজীবিতা গড়ে উঠেছিল, তার সংক্ষিপ্ত নাম হিসেবে এই শব্দবন্ধ উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
এখন এই শব্দবন্ধ কেউ ব্যবহার করেন না। ওয়াশিংটনের দুই রাজনৈতিক দল প্রায় কোনো বিষয়ে একমত না হলেও একটি বিষয়ে তারা একমত—সেটি হলো, উভয় দলই চীনকে ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং মধ্যবিত্তের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার প্রাপ্য পরাশক্তির জায়গা দিতে নারাজ, এমনকি তারা চীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে উভয় দেশই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে এবং তার অংশ হিসেবে বিকল্প সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে।
সেই মিথোজীবিতার দিন সম্ভবত শেষ হয়ে এসেছে। দুই দেশই ইতিমধ্যে পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীন থেকে উৎপাদন বা কারখানা সরিয়ে রাজনৈতিকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশে নিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে বলে এসেছে, বাণিজ্য হলো চীনের গণতন্ত্রের উৎস। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তারা এখন বলছে, চীনের বর্তমান নেতৃত্ব বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে বিরোধী মত দমন করছে এবং দেশের বাইরে সামরিক শক্তি দেখাচ্ছে।
চীনের নেতারা একসময় মনে করতেন, অর্থনৈতিক একীভবনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে থাকা যাবে। কিন্তু তাঁরা এখন সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলদর্পী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, চীন থেকে সস্তা পণ্য কিনে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে ঠিক, কিন্তু এতে সমাজে তার গভীর প্রভাব পড়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সস্তা চীনা পণ্য আমদানির জোয়ারে সে দেশের উৎপাদন খাত থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কাজ চলে গেছে। অর্থনীতিবিদ ডেভিড এইচ অটোর, ডেভিড ডর্ন ও গর্ডন এইচ হ্যানসনের এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া যায়। শুধু উৎপাদন খাতেই নয়, এই সস্তা চীনা পণ্য আমদানির জেরে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর অর্থনীতির অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ মানুষের কাজ চলে গেছে।
মানুষের সেই ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেন। এক জনসভায় ট্রাম্প বলেন, ‘চীন আমাদের দেশকে ধর্ষণ করে চলছে, আমরা তা হতে দিতে পারি না। এটা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চৌর্যবৃত্তি।’
কিন্তু ট্রাম্পের এই জ্বালাময়ী ভাষণের সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাত ছিল। কারণ, চীনের সস্তা পণ্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণির মানুষেরা উপকৃত হচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের জ্বালাময়ী ভাষণ শ্রমিকশ্রেণির অনেক মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন ভঙ্গ করছে। এই অভিযোগের সত্যতা আছে। চীন সরকার দেশটির বড় বড় কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে ঋণ দেয়। এ ছাড়া চীন সরকার মুনাফার একটি অংশ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভাগাভাগি করে শ্রম আইন ও পরিবেশ আইনের খড়্গ এড়িয়ে চলে। চীনের বাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করতে পারে না। যারা চীনে বিনিয়োগ করেছে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ নির্লজ্জভাবে চুরি করা হয়েছে, নকল করা হয়েছে তাদের পণ্য।
এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে নানাভাবে লাভবান হয়েছে। চীনের সস্তা পণ্য বাজারে এসেছে বলে দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষের আয়বৃদ্ধির হার থমকে গেলেও তাঁরা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পেরেছেন। সে জন্য দেশটির করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ফুলেফেঁপে উঠেছে। কোম্পানিগুলো চীনে কারখানা করে মুনাফা করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই মুনাফার সিংহভাগই শেয়ারহোল্ডারদের ঘরে গেছে। এতে অনেক মানুষ পিছিয়ে পড়লেও ওয়াশিংটন তেমন কিছু করতে পারেনি।
এই সস্তা চীনা পণ্য আমদানির কারণে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের জন্য ট্রেড অ্যাডজাস্টমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। লক্ষ্য ছিল, সেই মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কিন্তু একসময় কংগ্রেস এই কর্মসূচিতে অর্থ দেওয়া অনেকটা কমিয়ে দেয়। ২০১৯ সালে যাঁদের এই সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল, সে বছর তাঁদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সহায়তা পান। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
এই বাস্তবতায় মার্কিনিদের মধ্যেই ক্রমেই এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং চীনের শিল্প একধরনের আগ্রাসী শক্তি। সুবিধা সব ওপরের দিকে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় মানুষের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে এত গভীর সম্পর্ক তৈরি করেও কেন সে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে পারল না, তা নিয়েও তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে চীন যে বাজার সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিল, তা–ও শেষ পর্যন্ত হয়নি। এর বদলে দেখা গেল, সি চিন পিং সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর আরও ক্ষমতায়ন করেছে এবং বেসরকারি খাতের ওপর হামলে পড়েছে। অর্থাৎ, চীনের অর্থনীতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে যেসব বিদেশি গাড়ি কোম্পানি চীনের বাজারে এসেছে, তাদেরকে চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এখন চীনে শত শত গাড়ি কোম্পানি গড়ে উঠেছে, যারা এসব বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান ব্যবহার করে এখন তাদেরই বাজার নিজেদের হাতে নিয়ে আসছে।
এসব কিছুর পরিণতি হিসেবে বর্তমানে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে চেষ্টা করছে বা নির্ভরশীলতা কমানোর যে চেষ্টা করছে, সেই প্রক্রিয়া খুবই গোলমেলে হয়ে উঠেছে।
বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে মার্কিন অর্থনীতি আরও ঘাতসহনীয় হয়ে উঠতে পারবে; কোভিডের কারণে যেমনটা হয়েছিল, সে ধরনের সরবরাহসংকট আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।
চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, ভিয়েতনামে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয়, তার কাঁচামাল ও উপাদান চীন থেকেই আসে। এর ফলে চাইলেই চীন থেকে একেবারে স্বাধীন হওয়া সম্ভব হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, তাতে এটা প্রায় অসম্ভব।