লোহিত সাগরে হুতি হামলার কারণে জাহাজের খরচ যতটা বাড়ল

লোহিত সাগরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ঘিরে হুতিদের নৌযানরয়টার্স ফাইল ছবি

লোহিত সাগরে কনটেইনার জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলা অব্যাহত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বিশ্বের অন্যতম বড় জাহাজ কোম্পানি মায়ার্সক সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে, এই পরিস্থিতি এক বছরের বেশি সময় ধরে চলতে পারে।

বিপদ এড়াতে অনেক জাহাজ এখন ঘুরপথে পণ্য পরিবহন করছে। এতে সময় ও খরচ—উভয়ই বেড়েছে। সিএনএন জানিয়েছে, জাহাজপ্রতি খরচ বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ ডলার।

মায়ার্সকের ভাষ্যমতে, এই পরিস্থিতি এক বছর ধরে চললে মূল্যস্ফীতির নতুন ঢেউ শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। যদিও খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার সংকট অতটা তীব্র হবে না।

ড্রেউরি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার সূচক অনুসারে, সাধারণ ৪০ ফুট কনটেইনারপ্রতি শিপিং খরচ এ সপ্তাহে ৩ হাজার ৭৮৬ ডলারে উঠেছে; ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় যা ৯০ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে চীনের সাংহাই থেকে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম পর্যন্ত একই আকারের কনটেইনার পরিবহনের ব্যয় এক বছর আগের তুলনায় ১৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৪২৬ ডলারে উঠেছে।

তবে মহামারির সময় জাহাজ পরিবহনের ভাড়া যতটা বেড়েছিল, এবার ততটা বাড়েনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনারের ভাড়া ১০ হাজার ৩৮০ ডলারে উঠে যায়। এ বিষয়ে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ সাইমন ম্যাকঅ্যাডাম বলেন, ‘আমরা মহামারির তুলনায় অনেক ভালো জায়গায় আছি’।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে গত বছরের নভেম্বরের শেষ দিকে লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে ইরান-সমর্থিত হুতি গোষ্ঠী। এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের পথ বেছে নেয়। সম্প্রতি হুতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অভিযান শুরু করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।

মায়ার্সকের প্রধান নির্বাহী ভিনসেন্ট ক্লার্ক সিএনএনকে বলেছেন, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই, যা দেখে মনে হতে পারে, শিগগিরই এই বাণিজ্যের পথ পুনরুদ্ধার করা যাবে। বরং লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হতে এক বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হবে।
সাগর ও আকাশপথে পণ্য পরিবহনবিষয়ক ডেটা সংস্থা জেনেটার প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড সিএনএনকে বলেন, আগে সুয়েজ খাল ব্যবহার করত, এমন কনটেইনারবাহী জাহাজের ৯০ শতাংশই আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্রপথ বেছে নিয়েছে।

এ পথ দিয়ে বাল্ক ক্যারিয়ারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ চলাচল করছে, শস্য বা সিমেন্টের মতো শুকনা পণ্য পরিবহন করছে এসব জাহাজ। জ্বালানি তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাসবাহী জাহাজের এক-চতুর্থাংশ উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। এতে ১৪ থেকে ১৮ দিন বেশি সময় লাগছে। সময়ের বাধা এড়াতে কিছু কোম্পানি আকাশপথও বেছে নিচ্ছে বলে জানান পিটার স্যান্ড।

পিটার স্যান্ড আরও বলেন, আকাশপথ ব্যবহারের কারণে ইউরোপের ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে গেছে। পোশাকের বিক্রি মৌসুমকেন্দ্রিক হওয়ায় আকাশপথে পরিবহন অনেক সময় বাঁচায়, কিন্তু এতে পরিবহনের খরচ বেড়েছে ১০ থেকে ২০ গুণ। গত তিন সপ্তাহে ভিয়েতনাম থেকে উত্তর ইউরোপে পোশাকের কার্গো আকাশপথে নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।

জাহাজ চলাচলের পথ বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে জ্বালানি ও বিমা খরচ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে চার্টার ফি ও মজুরি বিল। জেনেটার বিশ্লেষণ অনুসারে, মায়ার্সক ও হ্যাপাগ-লয়েডের মতো বৃহৎ জাহাজ কোম্পানিগুলো উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে পরিবহনের জন্য জাহাজপ্রতি অতিরিক্ত ১০ লাখ ডলার ব্যয় করছে। এই ব্যয়ের বড় একটি অংশই যায় জ্বালানি বাবদ। বলা বাহুল্য, এই ভার শেষমেশ ক্রেতার ওপরই পড়ে।

লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করেছে মিসরের সুয়েজ খাল। বিশ্ববাণিজ্যের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এই পথে হয়, জ্বালানি তেলসহ। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক কনটেইনার জাহাজের ৩০ শতাংশ এই পথে চলাচল করে।

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের আরেকটি সংবাদে বলা হয়েছে, জাহাজশিল্পের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এখন পরিবহনের সময় বেড়ে গেলেও খুব একটা সমস্যা হবে না। ২০২০ সালের কোভিডের সময় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এখন তেমনটা হবে না। লোহিত সাগরের এই গোলযোগের কারণে জাহাজভাড়া দ্বিগুণ হতে পারে। কিন্তু জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান জেনেটার পিটার স্যান্ড মনে করেন, মহামারির সময় জাহাজভাড়া যে পর্যায়ে উঠেছিল, এখন তার চেয়ে অনেক নিচেই থাকবে। ফলে জাহাজ কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমবে।

এ ছাড়া জাহাজশিল্পের উত্থান-পতন স্বাভাবিক বিষয়। জন ম্যাককাউনন কনটেইনারের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের জাহাজশিল্পের মুনাফা ছিল ২১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। অথচ ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই শিল্পের সম্মিলিত ক্ষতি হয়েছে ৮৫০ কোটি ডলার। জাহাজশিল্পের মুনাফা বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্যভাবে তারা নতুন নতুন জাহাজে বিনিয়োগ করেছে। সেসব নতুন জাহাজ এখন সাগরে নামতে শুরু করেছে। আইএনজি ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক জাহাজ পরিবহনের সক্ষমতা ৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ১১ শতাংশ বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালে জাহাজশিল্পের মুনাফা ৮০ শতাংশ কমেছে।

মায়ার্সকের প্রধান নির্বাহী ভিনসেন্ট ক্লার্ক সিএনএনকে বলেন, বর্তমান জাহাজসংকট মহামারিকালীন সংকটের পুনরাবৃত্তি নয়। এই সংকটের পরিধি অনেক সীমিত।
কনটেইনার শিপিং এখনো ‘খুব সাশ্রয়ী’; একসঙ্গে অনেক পণ্য পরিবহন করা যায় বলে ইউনিটপ্রতি ব্যয় খুব একটা ব্যয় বাড়ে না। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বলেছে, পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে জোটের ৩৮টি সদস্য দেশে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি প্রায় এক বছর পর দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়তে পারে।